Advertisement
২২ মে ২০২৪

বাবাকে হারিয়েও পড়ার জেদে কৃতী

উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের আগে বাবার অকাল মৃত্যুতে দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল মেয়েটির। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা, সংসার চলবে কী ভাবে, সেটাই বারবার কুরে কুরে খেয়েছে মেয়েটিকে। তাতেও হার মানেনি পাত্রসায়রের বীজপুর গ্রামের মন্দিরা পাত্র।

মন্দিরা পাত্র

মন্দিরা পাত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০১:০৪
Share: Save:

উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের আগে বাবার অকাল মৃত্যুতে দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল মেয়েটির। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা, সংসার চলবে কী ভাবে, সেটাই বারবার কুরে কুরে খেয়েছে মেয়েটিকে। তাতেও হার মানেনি পাত্রসায়রের বীজপুর গ্রামের মন্দিরা পাত্র। শত অভাবকে দূরে ঠেলে এবার উচ্চমাধ্যমিকে ৪২০ পেয়ে নজর কেড়েছে সে।

কিন্তু, মেয়ের এত ভাল ফল বিপাকে ফেলেছে তার বিধবা মা মুক্তা পাত্রকে। সংসারে সম্বল বলতে কয়েক কাঠা জমি। তা থেকেই টেনেটুনে সংসার চলে। এখন কী ভাবে মন্দিরাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন, সেটাই ভাবিয়ে তুলেছে মুক্তাদেবীকে। শালি নদীর কোলঘেঁষা বীজপুর গ্রাম। গ্রামের পাত্রপাড়ায় খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ি মন্দিরাদের। তার বাবা নবগোপাল পাত্র বর্ধমানের একটি চালকলে কাজ করতেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি মারা যান। বাড়িতে এখন তাঁর স্ত্রী, মেয়ে মন্দিরা ও ছেলে মৌনব্রত। বাড়িতে বিদ্যুতের স্থায়ী সংযোগ নেই। পাশের বাড়ির জ্যাঠার কাছ থেকে বিদ্যুতের তার টেনে আলো জ্বলছে বাড়িতে।

হত দরিদ্র এই পরিবারেরই মেয়ে মন্দিরা ইন্দাস হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সব ক’টি বিষয়ে লেটার নিয়ে ৪২০ পেয়েছে। তার প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৮১, ইংরেজিতে ৮০, রসায়নে ৮৫, পদার্থবিদ্যায় ৮৪ ও জীববিদ্যায় ৮৭। মন্দিরার প্রিয় বিষয় রসায়ন। মাধ্যমিকে ৬১৫ পেয়েছিল সে। সারাদিনে ৮-১০ ঘন্টা পড়ার ফাঁকে তার নেশা ছবি আঁকা। তবে অবসর সময়ে গল্প বই পড়তে ভালবাসে মন্দিরা। প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লক্ষ্যে এ বার জয়েন্ট দিয়েছে। কিন্তু, র্যাঙ্ক পেয়েছে মেডিক্যালে। তবে, তা এতই কম যে, আপাতত রসায়ন নিয়েই অনার্স পড়ার ইচ্ছে রয়েছে তার। মন্দিরার কথায়, “টেস্টের আগে বাবা মারা যাওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তার পর মা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়াচ্ছেন। তাই ভাল ফল করার একটা জেদ আমার ছিলই। তবে, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল আর একটু ভাল হলে খুশি হতাম।”

নিজের শিক্ষকদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ মন্দিরা। সে জানায়, মাধ্যমিকের আগে থেকেই বীজপুরের প্রাইভেট শিক্ষক জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্য পাত্র তাকে পড়ানোর পাশাপাশি নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। বিনা পয়সায় ইংরেজি পড়িয়েছেন অনিমেষ মণ্ডল, অঙ্ক পড়িয়েছেন অনিরুদ্ধ বসু। তারক সরকার রসায়ন, অনুপম চক্রবর্তী জীববিদ্যা পড়িয়েছেন বেতন ছাড়াই। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাকে অনেক সাহায্য করেছেন। এই কৃতী ছাত্রী বলে, “এলাকার বহু সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া আমি এত দূর পড়াশোনা করতে পারতাম না। আমি ওঁদের সকলের কাছেই ঋণী।”

কিন্তু, তার ভাল ফল বাবা দেখে যেতে পারলেন না বলে আক্ষেপ সব সময়ই রয়েছে মন্দিরার। মেয়ের সাফল্যে বুক ভরে গেলেও অন্য আশঙ্কা গ্রাস করেছে মুক্তাদেবীকে। বললেন, “সংসার চালানোই দায়। ছেলে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। আবার মেয়ে আরও পড়বে বলছে। বিনা পয়সায় এত দিন সবাই টিউশনি করাচ্ছেন ওদেরকে। এখন কী করে যে দিদি-ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোটাবো, তা ভেবে রাতে ঘুম হচ্ছে না।” ইন্দাস হাইস্কুলের টিচার ইন চার্জ শ্রীকুমার দে বলেন, “শত অভাবের মধ্যেও কষ্ট করে মন্দিরা যে রেজাল্ট করেছে, তা প্রশংসনীয়। আমাদের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়াশোনার জন্য সাহায্য করেছেন মন্দিরাকে। আগামী দিনেও ওকে আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patrasayar mandira patra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE