মাওবাদী দমনে এখনও ওঁদের প্রয়োজন। টহলদারি নাগা বাহিনীর জওয়ানেরা। বাঘমুণ্ডিতে অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে।—ফাইল চিত্র।
রাস্তায় ভিড় থাকায় পেরনোর পথ না পেয়ে কখনও নিরীহ পথচারী বা দোকানদারদের বেধড়ক মার, কখনও গাড়ি বোঝাই কাঠের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় বনকর্মীদের মারধর, কখনও চায়ের দাম চাওয়ার জেরে দোকানদারের সঙ্গে বচসা এবং তার জেরে রক্ষী শিবির থেকে সহকর্মীদের ডেকে এনে দোকানদারকে মারধর। এর সঙ্গেই জুড়েছে পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় পাখি কিংবা বন্যপ্রাণ মেরে ফেলার অভিযোগ।
সব মিলিয়ে, মাওবাদী মোকাবিলায় জেলায় মোতায়েন নাগাল্যান্ডের ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ন (আইআরবি)-এর জওয়ানদের একাংশের বিশৃঙ্খল আচরণের অভিযোগকে ঘিরে জেরবার পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। ছ’বছর হতে চলল ওই জওয়ানেরা এই জেলায় রয়েছেন। কিন্তু, ফি-বছর একাধিক অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। আগের ব্যাটিলয়ন বদলি করে নতুন ব্যাটেয়িলন আনা হয়েছে। বর্তমানে ১২ নম্বর নাগা ব্যাটেলিয়ন রয়েছে পুরুলিয়ায়। বলরামপুরের কুমারী কানন (অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে), বলরামপুরের পাথরবাঁধ, বাঘমুণ্ডি (পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ জলবিদ্যুত প্রকল্পের অফিসের সামনে), অযোধ্যা হিলটপ, আড়শার শিরকাবাদ ও কোটশিলার মুরগুমা-- এই ছয়টি শিবির রয়েছে নাগা বাহিনীর।
তবে, নতুন ব্যাটেয়িলন আসার পরেও পরিস্থিতির বদল খুব একটা হয়নি বলে অভিযোগ। এ বছরও ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাঘমুণ্ডির লহরিয়ায় দু’টি ময়ূর মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে ওই জওয়ানদের বিরুদ্ধে। ঘটনা প্রবাহে শেষ সংযোজন, গত সপ্তাহে আড়শার গন্ধবাজার গ্রামে এক পূজারিকে মারধর। ওই জওয়ানদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ক্ষোভও বাড়ছে। পূজারিকে মারধরের জেরে এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের হাতে নাগা বাহিনীর দুই জওয়ানও মার খান। পূজারি-সহ তিন জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
বারবার বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় নাম জড়ালেও কী ভাবে নাগা ব্যাটেলিয়নের জওয়ানদের এমন আচরণ ঠেকানো যাবে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না জেলার পুলিশ কর্তারা। সেই ২০০২ সালের নভেম্বরে কোটশিলার বাঁশগড়ে (তত্কালীন ঝালদা থানা) জোতদার জগদীশ তিওয়ারির বাড়িতে হানা দিয়ে পারিবারিক মন্দিরে হাঁড়িকাঠে ওই ব্যক্তির মাথা কেটে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে জঙ্গলমহলের এই জেলায় মাওবাদীদের নাশকতা শুরু। পরের বছর অক্টোবরে বান্দোয়ান থানার ওসি নীলমাধব দাসকে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা বা তার পরে বান্দোয়ানেই সিপিএম নেতা রবীন্দ্রনাথ করকে সস্ত্রীক পুড়িয়ে মারা-সহ জেলায় মাওবাদী নাশকতার একাধিক ঘটনা ঘটে।
২০০৯ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাওবাদীরা ঘাঁটি তৈরি করে ফেলে এবং পরের পর নাশকতা চালাতে থাকে। বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি, ঝালদা, আড়শা, কোটশিলা, বরাবাজার-সহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন থানা এলাকায় মাওবাদী নাশকতা রুখতে ২০১০ সালের অগস্ট নাগা বাহিনীকে পুরুলিয়ায় মোতায়েন করা হয়। সমস্যার শুরু তার পরেই। ওই বছরই ৩০ সেপ্টেম্বর বলরামপুর বাজারে জাতীয় সড়কের উপরে গাড়িতে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে নাগা বাহিনীর এক জওয়ানের বিরুদ্ধে। গুলিবিদ্ধ হয়ে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এক জন আহত হন। তা নিয়ে তুমুল হইচই হয় জেলায়। তার পরেই ১ ডিসেম্বর বলরামপুর কমিউনিটি হলে নাগা বাহিনীর শিবিরে এক জওয়ানের হাতে গুলিবিদ্ধ হয় রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এক জওয়ান এবং নাগা বাহিনীর এক জওয়ান।
অভিযোগের তালিকার এখানেই শেষ নয়। অযোধ্যা পাহাড়ে গাড়ি বোঝাই করে নাগা বাহিনীর কয়েক জন সদস্যকে কাঠ নিয়ে যেতে দেখে দুই বনাধিকারিক সেই কাঠের নথি দেখতে চাইলে বনকর্মীদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ২০১৩ সালের মে মাসে শিরকাবাদে চা খেয়ে চায়ের দাম মেটানো নিয়ে দোকানদারের সঙ্গে বচসা কিংবা ওই বছরই নভেম্বরে বেগুনকোদরে রাস্তায় যানজট থাকায় পথচারীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন কিছু নাগা জওয়ান। দুই জায়গাতেই শিবির থেকে সহকর্মীদের ডেকে এনে ওই চায়ের দোকানদার বা এলাকার লোকজনকে বেধড়ক মারধর করেন জওয়ানেরা। এর পরে ক্ষোভ চরমে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে এলাকার বাসিন্দারা নাগা বাহিনীর অপসারণের দাবিতে মিছিল করেন। এরই মাঝে ২০১৩-র জুলাই মাসে পুরুলিয়া শহরে বাজার করতে এসে রাস্তায় বসে থাকা একটি নেড়ি কুকুরকে আচমকা গুলি করে মারেন এক নাগা জওয়ান। এই ঘটনাকে ঘিরেও শহরে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই ১০ নম্বর নাগা ব্যাটেলিয়নকে বদলি করে ১২ নম্বর ব্যাটেলিয়ন আনা হয়।
কিন্তু, তাতেও অবস্থার আদৌ বদল ঘটেনি বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। চলতি বছরও ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ময়ূর মেরে ফেলা কিংবা পূজারিকে মারধরের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ওই বাহিনীর। কিন্তু, নাগা বাহিনীকে পুরোপুরি জেলা থেকে সরিয়ে দিতেও পারছেন না পুলিশের কর্তারা। কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “মাওবাদী নাশকতা রুখতেই জেলায় আনা হয়েছিল নাগা বাহিনীকে। মাওবাদীদের অযোধ্যা পাহাড়ের স্কোয়াড ভেঙে গেলেও জেলার অবস্থা এখনও এমন জায়গায় পৌঁছয়নি যে নাগা বাহিনীর শিবিরগুলি তুলে দিতে হবে। কেন না এখনও মাঝে মাঝেই মাওবাদী নামঙ্কিত প্রচারপত্র, পতাকা বা পোস্টারের হদিস মিলছে অযোধ্যা পাহাড় বা পাহাড়তলিতে।” ওই পুলিশকর্তা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর মাওবাদীদের একটি দল বলরামপুর থানার খুনটাঁড় গ্রামে তৃণমূল কর্মী রাজেন সিংহ সর্দারের বাড়িতে হানা দেয়। তাঁকে বাড়িতে না পেলেও তাঁর বাবা ও ভাইকে গুলি করে মারে। অপারেশন সেরে ফেরার মুখে মাওবাদীদের স্কোয়াডটি যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি পড়ে যায়। গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয় দুই মাওবাদী সুরেশ ও বিদ্যুতের। গুলিযুদ্ধে নিহত হন মাসিভিকো অ্যাং নামে নাগা বাহিনীর এক জওয়ানও। ওই ঘটনার পরে যৌথ বাহিনীর লাগাতার আক্রমণে অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে মাওবাদীদের মাজা কার্যত ভেঙে গেলেও এখনও তাদের গতিবিধি রয়েছে বলেই গোয়েন্দারা জেনেছেন। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এটা মানতেই হবে, মাওবাদী দমনে পুরুলিয়ায় নাগা বাহিনী বড় ভূমিকা নিয়েছে। তাদের ভূমিকা এখনই শেষ হয়ে গিয়েছে, এটা এত দ্রুত বলা যাচ্ছে না। মাওবাদী নাশকতা ফের যে শুরু হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?”
এই অবস্থায় নাগা বাহিনী ঠিক কী করা উচিত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে পুলিশ মহলে। বলরামপুরে সহকর্মীদের গুলি করে মারার ঘটনা ছাড়া অন্য অভিযোগগুলির প্রেক্ষিতে নাগা জওয়ানদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন তথ্য জেলা পুলিশ সূত্রে মেলেনি। বলরামপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “নিরাপত্তার প্রশ্নে এই বাহিনী তাদের কাজ করে। কিন্তু তাদের কিছু সদস্য কখনও কখনও বিশৃঙ্খল আচরণ করে ফেলেন।” এর ফলে এলাকার মানুষজনের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় জওয়ানদের, সে কথা মেনে নিয়ে তিনি বলেন, “কী করে বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমন্বয় বাড়ানো যায়, তা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলব।” পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, “আসলে এই বাহিনীর জওয়ানেরা একটা পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ পৃথক পরিবেশে আছেন। ফলে, তাঁদের কারও কারও কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমরা ওই সব অঞ্চলে কিছু জনসংযোগ কর্মসূচি চালাব। এই কর্মসূচি নাগা বাহিনীর জওয়ানেরাই করবেন।”
তাতে কতটা কাজ হবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।
কাঠগড়ায় নাগা বাহিনী
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১০: বলরামপুরে গাড়িতে গুলি চালিয়ে এক আরোহীকে হত্যা, আহত এক।
১ ডিসেম্বর, ২০১০: বলরামপুরে নিজেদের রক্ষী শিবিরে গুলি চালিয়ে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এক জওয়ান-সহ দুই সহকর্মীকে হত্যা।
নভেম্বর, ২০১১: বাঘমুণ্ডিতে দুই বনকর্মীকে মারধর।
৬ মে, ২০১৩: শিরকাবাদে চায়ের দাম মেটানোকে কেন্দ্র করে বচসা। দোকানদারকে মারধর।
২৫ জুলাই, ২০১৩: পুরুলিয়া শহরে হাটমোড়ে কুকুরকে গুলি করে হত্যা।
২৩ নভেম্বর, ২০১৩: বেগুনকোদরে রাস্তায় যানজট থাকায় পেরোনোর পথ না পেয়ে পথচারীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি। পরে শিবির থেকে সহকর্মীদের ডেকে এনে বেপরোয়া লাঠিচার্জ।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫: বাঘমুণ্ডির লহরিয়ায় দু’টি ময়ূর মারার অভিযোগ।
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫: আড়শার গন্ধবাজারে প্রতিবন্ধী জওয়ানকে মারধর। উত্তেজিত জনতার হাতে প্রহৃত দুই নাগা জওয়ান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy