Advertisement
১৮ মে ২০২৪

বৃহস্পতিবারই বাড়ি ফিরল নিরুদ্দেশ বৃহস্পতি

স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আট মাসের ছেলেই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সম্বল। কিন্তু, বছর দশেক বয়সে হঠাৎই স্কুলে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় সেই ছেলে। সেটা পাঁচ বছর আগের কথা। তার পর থেকে ছেলেকে খুঁজে হন্যে হয়েছেন বাবা। কোথাও কোনও হদিস না পেয়ে যখন সব আশাই কার্যত ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই বাড়িতে এসে এক জন তাঁকে বললেন, ‘ছেলের কাছে চলুন’!

হোমে বাবার সঙ্গে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

হোমে বাবার সঙ্গে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫২
Share: Save:

স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আট মাসের ছেলেই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সম্বল। কিন্তু, বছর দশেক বয়সে হঠাৎই স্কুলে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় সেই ছেলে। সেটা পাঁচ বছর আগের কথা। তার পর থেকে ছেলেকে খুঁজে হন্যে হয়েছেন বাবা। কোথাও কোনও হদিস না পেয়ে যখন সব আশাই কার্যত ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই বাড়িতে এসে এক জন তাঁকে বললেন, ‘ছেলের কাছে চলুন’!

পাঁচ বছর আগের সেই নিরুদ্দেশ ছেলে বৃহস্পতিকে বাঁকুড়ার হোম থেকে বাবা বাড়ি নিয়ে গেলেন বৃহস্পতিবারই!

ছেলেকে ফিরে পেয়ে ঝাড়খণ্ডের সরাইকিলা-খরসঁওয়া জেলার মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা লালদেব সিংহের দু’চোখের জল যেন বাগ মানছিল না। আঁকড়ে ধরে আছেন ছেলেকে। বয়সের ভারে মুখের প্রায় সব ক’টি দাঁতই পড়ে গিয়েছে লালদেববাবুর। অস্পষ্ট গলাতেই ওই প্রান্তিক চাষি জানান, ছেলে হওয়ার আট মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রী বিলাসীদেবী মারা যান। এর পর থেকে ছেলের দেখভাল তিনি নিজেই করছিলেন। তবে জন্ম থেকেই ছেলের মানসিক কিছু সমস্যা ছিল। স্থানীয় কেতুঙ্গা হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন ২০১০ সালে নিখোঁজ হয়ে যায় বৃহস্পতি। লালদেব বলেন, “স্কুলে যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছিল ছেলে। আর বাড়ি ফেরেনি। অনেক খোঁজ করেছিলাম। পুলিশেও জানিয়েছিলাম। কিছু হয়নি।”

ওই বছরই বাঁকুড়ার তালড্যাংরার রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকা বৃহস্পতিকে উদ্ধার করে পুলিশ। এর পর চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির নির্দেশে বাঁকুড়ার কেঠারডাঙার একটি বেসরকারি হোমে তাকে রাখা হয়। তখন বৃহস্পতির বয়স ১১। হোমের সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ সামন্ত জানাচ্ছেন, প্রথম থেকেই খুব চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে ছিল বৃহস্পতি। তবে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলায় সে বেশ দক্ষ। কিন্তু কোনও কথাই সে সম্পূর্ণ বলতে পারে না। অনেক সাধাসাধির পরে দু-একটি শব্দ বললেও তা বোধগম্য হত না হোমের কর্তাব্যক্তিদের। তাকে বারবার বাড়ির ঠিকানা, বাবার নাম জিজ্ঞেস করা হত, কিন্তু সে কোনও উত্তরই দিতে পারত না। নিজের নাম বললেও পদবি বলতে পারেনি সে। এ ভাবে পার হয়ে যায় বেশ কয়েক বছর। সমানে চলতে থাকে কাউন্সেলিং।

গত আট মাসে বৃহস্পতির চরিত্রে কিছু পরিবর্তন হতে থাকে। আগের চেয়ে কিছুটা বেশি কথা বলতে শুরু করে সে। সত্যেন্দ্রনাথবাবুর কথায়, “মাসখানেক আগে ওকে কাউন্সেলিং করার সময় একটি স্কুলের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় ওর গ্রামে কোনও স্কুল রয়েছে কিনা। তখনই বৃহস্পতি প্রথমবার কেতুঙ্গা হাইস্কুলের কথা বলে। এর পর বাবার নাম জানতে চাওয়া হলে আধো উচ্চারণে লালদেববাবুর নাম বলে সে। ও ঠিক কী নাম বলছে, সেটা প্রথমে বুঝতে পারিনি আমরা। ভেবেছিলাম লাভদেব বলছে।” ওটা যে লালদেব, তা বুঝতে আরও দু’মাস পেরিয়ে যায়। তত দিনে কেতুঙ্গা হাইস্কুলের খোঁজ শুরু করেন হোম কর্তৃপক্ষ। কেঠারডঙার এই হোমটি চালায় যে সংস্থা, তাদেরই মেয়েদের একটি হোমের এক আবাসিকের বাবা, পুরুলিয়ার বলরামপুরের বাসিন্দার কাছ থেকে কেতুঙ্গা হাইস্কুলের খোঁজ পান হোম কর্তৃপক্ষ।

গ্রাম সংলগ্ন মধুপুর গ্রামের কথা বৃহস্পতিকে বলতেই সেখানেই তার বাড়ি বলে হোম কর্তৃপক্ষকে জানায় বৃহস্পতি। মধুপুরের এক গ্রামীণ ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হোম কর্তৃপক্ষ লালদেববাবুর খোঁজ পান। ওই ডাক্তারই লালদেববাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বৃহস্পতির সন্ধান দেন। খবর পাওয়ার পরেই বাঁকুড়ার হোমে ছুটে আসেন লালদেববাবু। বাবাকে দেখে চিনে ফেলে বৃহস্পতিও। বাবার কাছে বাড়ি যাওয়ার আর্জি জানায় সে। হোম কর্তৃপক্ষ লালদেববাবুকে ছেলেকে নিয়ে যেতে উপযুক্ত প্রমাণপত্র আনতে বলেন।

বুধবার বাঁকুড়া চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান সোমা কাঞ্জিলালের কাছে প্রমাণপত্র জমা করে ছেলেকে ফিরে পান লালদেববাবু। ওই রাত বাঁকুড়ার হোমে কাটিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরেই ট্রেন ধরে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। সোমাদেবী বলেন, “সাধারণত শিশুরা অচেনা পরিবেশে এসে খুব ভয় পেয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। বৃহস্পতির জন্ম থেকেই কিছু মানসিক সমস্যা ছিল। এই পরিস্থিতিতে ওর পরিচয় উদ্ধার করা খুবই কঠিন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ওকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পেরে ভাল লাগছে।”

যাওয়ার আগে হোমে দাঁড়িয়ে বৃহস্পতি বলে, “আমি ১০-১২ দিন বাড়িতে থাকব। তারপর আবার এখানে চলে আসব।” লালদেববাবু যদিও বলেন, “ছেলেকে ফিরে পেয়ে আমি নতুন করে জীবন পেলাম। আর ওকে আমার চোখের আড়ালে যেতে দেব না। ও ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

missing son rajdeep bandyopadhyay bankura
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE