প্রশাসনের নজরে আসাই সার। নাবালিকা বিয়ে রুখতে বহু ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছে না বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। অথচ, নাবালিকার বিয়ে রুখতে তৈরি হয়েছে কড়া আইন। রাজ্য সরকারের তরফে কন্যাশ্রী-র মতো প্রকল্পও চালু হয়েছে, যা থেকে পড়াশোনা করার জন্য দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। এত কিছুর পরেও কেন নাবালিকা বিয়ে রোখা যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।
দেড় সপ্তাহ আগে বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর মন্দিরে বিয়ে করতে এসেছিল ওন্দা থানার বাসিন্দা এক অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও এক নাবালিকা। বিষয়টি মন্দির কমিটির চোখে পড়লে বাঁকুড়া সদর থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে দু’জনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গিয়ে কাউন্সেলিং করে। চাইল্ড লাইনের কর্মীরা খবর পেয়ে থানায় যান। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে বিয়ে করবে না বলে মুচলেকাও দেয় দু’জনে। এর পর দু’জনকেই বাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু, তাদের উপরে নজর রাখা ঠিক মতো হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে গত সোমবার বিয়ে দেওয়া হয় তাদের। কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখতে বৈঠকে বসা হবে বলে জানিয়েছে জেলা সমাজ কল্যাণ দফতরের জেলা আধিকারিক সুরেন্দ্রপ্রসাদ ভকত। তিনি বলেন, “আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও চাইল্ড লাইনের তরফে কোনও গাফিলতি রয়েছে কি না, তা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ওন্দার ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। খবর পাওয়ার পরেও বিয়ে রুখতে অসফল হওয়ার মতো বহু ঘটনার উদাহরণ রয়েছে বাঁকুড়া জেলায়। সম্প্রতি বাঁকুড়া চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির তরফে জেলাশাসক ও রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিটিকে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে গত এক বছরে জেলা চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটির কাছে ১৮টি নাবালিকা বিয়ের ঘটনার খবর এসেছে। যার মধ্যে পাঁচটি বিয়ে বন্ধ করা যায়নি। যার কারণ হিসেবে জেলার মহকুমা স্তরের পুলিশ ও প্রশাসনিক মহলের গাফিলতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্যদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়েছে রিপোর্টে। এ ছাড়াও প্রতিবছর জেলার সব ক’টি ব্লক থেকে তিন চারটি নাবালিকা বিয়ের ঘটনা ঘটছে এবং তা বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান সেখ মুরসালিন। তাঁর অভিযোগ, “নাবালিকা বিয়ে রোখার ঘটনায় প্রশাসনিক আধিকারিক ও পুলিশের গাছাড়া মনোভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের খবর দেওয়ার পরেও তাঁরা পদক্ষেপ করেন না। পদক্ষেপ করলেও সেই নাবালিকার পরিবারের উপরে নজরদারি চালানো হয় না।” তাঁর দাবি, প্রশাসনের তরফে নজরদারি না চালানোর সুযোগেই বিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার মাস খানেক পরে ফের বিয়ের তোজজোড় করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ওই নাবালিকার। এ ভাবেই খবর পাওয়ার পরেও পাঁচটি নাবালিকার বিয়ে রোখা যায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরও জানান, নাবালিকা অবস্থায় কোনও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলে তার পরিবারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতেই পারে। এ ক্ষেত্রেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষেই সওয়াল করেছেন তিনি।
সম্প্রতি বিষ্ণুপুর মহকুমার জয়পুর থানার একটি গ্রামের একটি ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। গ্রামেরই সংখ্যালঘু পরিবারের একটি ১৩ বছরের ছাত্রীর বিয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে সতর্ক করে এসেছিল। কিন্তু পুলিশের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করেই বিয়ের তোড়জোড় চলতে থাকে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি বিয়ের আগে ক্ষীর খাওয়ানোর অনুষ্ঠানও হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়ে যেতেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বুধবার গ্রামে যায় বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কর্মীরা।
জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সেখ ইয়ামিন বলেন, “গ্রামে সভা করে এই বিয়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা হয়। বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।” স্থানীয় সূত্রে খবর, নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে দেওয়া এই গ্রামে কার্যত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূলে দারিদ্র অনেকাংশে রয়েছে। নাবালিকা অবস্থায় বিয়ের ফলে বহু মেয়েই বিয়ের পরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। গ্রামে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ইয়ামিন সাহেব এই কথা মেনে নিয়ে বলেন, “নাবালিকা বিয়ে রুখতে গ্রামে গ্রামে সভা করব। সমস্ত স্তরের জন প্রতিনিধিদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি আমি।”
জেলায় নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার বিষয়ে জোর কদমে সচেতনতা মূলক প্রচার চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অদিতি দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, “প্রশাসন থেকে বিভিন্ন স্কুলে, গ্রামাঞ্চল স্তরে আমরা নাবালিকা বিয়ে রুখতে মানুষকে সচেতন করছি।” তবে একই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “এটা কোনও একটি দফতরের পক্ষে রোখা সম্ভব নয়। সর্বস্তরের মানুষকে একসাথে এগিয়ে এসে এই ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।”
তবে নাবালিকা বিয়ে রোখার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটি তা ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। তিনি বলেন, “নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে খবর পেলেই পুলিশ গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে। এ ভাবে বহু বিয়ে বন্ধ করেছে জেলা পুলিশ।” তাঁর দাবি, “বর্তমানে নাবালিকা বিয়ে অনেকটাই কমেছে জেলায়। এই ধরনের ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না।” তবে আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ বিয়ে দিলে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেবে বলেই জানিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy