খাতড়ার কেচোন্দাঘাটে ভারী বর্ষায় ভেসে যায় কজওয়ে।
বর্ষা আসে, বর্ষা পেরিয়ে যায়। কিন্তু বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে আজও খাতড়া ব্লকের কেচোন্দা ঘাটে কংসাবতী নদীর উপরে অসম্পূর্ণ সেতুর কাজ শেষ হল না। বামফ্রন্ট আমলে অসম্পূর্ণ সেতুর কাজ এখনও সেই একই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে এ বারও কেচোন্দাঘাটে নীচু কজওয়ে বর্ষায় ফুলে ওঠা কংসাবতীর জলে ভেসে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
যদিও প্রশাসনের আশ্বাস, বাসিন্দাদের দাবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে আসার পরেই ওই সেতুর কাজ শেষ করার জন্য প্রায় নয় কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। শীঘ্রই ওই কাজের জন্য টেন্ডার ডাকা হবে। বর্ষা বিদায় নিলেই কাজ শুরুর আশ্বাস মিলেছে।
বাঁকুড়া থেকে খাতড়া, রানিবাঁধ হয়ে ঝাড়খণ্ডের টাটা বা জামশেদপুর যাওয়ার প্রধান রাজ্য সড়ক এটাই। ফি বর্ষায় কেচোন্দাঘাটে এই নীচু কজওয়ের উপর দিয়ে কংসাবতী নদীর জল বয়ে যায়। সেই সময় ওই কজওয়ের উপর দিয়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে। দু’পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে খাতড়া, রানিবাঁধ ও রাইপুর ব্লকের প্রায় ১০০টি গ্রামের বাসিন্দা নদী পেরোতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। সেই সমস্যা দূর করতে ২০০৫ সালে ওই কজওয়ের পাশেই একটি উঁচু সেতু তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২৭৫ মিটার দীর্ঘ ও ৩৪ ফুট চওড়া এই সেতু নির্মাণের জন্য ৭ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য পূর্ত দফতর (সড়ক)। ২০০৬ সালের ১ মার্চ বিধানসভা ভোটের আগে এই সেতু শিলান্যাস করেন রাজ্যের তদানীন্তন অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দফতরের প্রতিমন্ত্রী তথা রাইপুরের বিধায়ক উপেন কিস্কু। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দু’বছরের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হবে। তারপর দু-দু’টি পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন পেরিয়ে গিয়েছে। শিলান্যাসের পরে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলেও মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অবশ্য পূরণ হয়নি।
উঁচু সেতু তৈরির কাজ আজও শেষ হয়নি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রথম থেকেই অত্যন্ত ঢিমেতালে কাজ চলছিল। ১৫টি পিলার তৈরির পরে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে হঠাৎই কাজ বন্ধ করে দেয় সেতু নির্মাণের বরাত প্রাপ্ত বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা। তারপর প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই সেতু তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। গত বছর পুজোর পরে বাঁকুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারিকুলের পূর্ণাপানি ময়দানে ওই কজওয়ে পেরিয়ে তিনি সভা করতে যাওয়ার সময় বাসিন্দারা অসম্পূর্ণ সেতুর কাজ শেষ করার অনুরোধ প্ল্যাকার্ডে লিখে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী সভায় ঘোষণা করে দেন ওই সেতুর জন্য দ্রুত অর্থ বরাদ্দ করে দেওয়া হবে। এ জন্য নতুন করে প্ল্যান ও এস্টিমেট পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দেন তিনি। প্রশাসন সূত্রের খবর সেই প্ল্যান ও এস্টিমেট নতুন বছরের গোড়ায় রাজ্য পূর্ত দফতর (সড়ক) এর কাছে পাঠানো হয়। লোকসভা নির্বাচনের পরে ওই প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু কাজের টেন্ডার এখনও হয়নি। তাই সেতুর কাজ শুরু হয়নি।
তার প্রেক্ষিতেই বাসিন্দাদের আক্ষেপ, টাকা এসেও টেন্ডার ডাকতে দেরি হচ্ছে কেন? রানিবাঁধের দেউলি-শুক্লা হাইস্কুলের শিক্ষক সম্পদ খাঁড়াৎ, উত্তম পাল, বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বর্ষাকালে কেচোন্দা ঘাটে নিচু কজওয়ের উপর দিয়ে জল যায়, তখন অম্বিকানগর হয়ে ঘুরপথে যাতায়াত করতে হয়। সেতুটা তৈরি হলে এই সমস্যা হত না।” রানিবাঁধের শঙ্কর সর্দার, দুর্গাপদ মান্ডি, বারিকুলের দুর্গা সোরেনদের আক্ষেপ, ২০০৬ সাল থেকে সেতু তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এখনও শেষ হল না। এ বারও ভারী বর্ষা হলে ওই কজওয়ে আবার ভাসবে।
রাজ্য পূর্ত দফতর (সড়ক) এর বাঁকুড়া ডিভিশনের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সৌগত সরকার বলেন, “আগের সংস্থাটি কাজ শেষ করেনি বলে জরিমানা করা হয়েছে। সেই জন্য সেতু তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। নতুন সেতু তৈরির প্রক্রিয়াগত কাজ চলছে।” বাঁকুড়া জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শ্যামল সরকারের বক্তব্য, “এই সেতুর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য ৮ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রক্রিয়াগত কিছু কারণে টেন্ডার এখনও ডাকা হয়নি। টেন্ডার হয়ে গেলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।” তাঁর কটাক্ষ, বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে এই সেতু নির্মাণের কাজ সময়ে শেষ করার দায়িত্ব ছিল বামফ্রণ্ট সরকারের। তারা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা এখন ওই কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।”
যিনি এই সেতুর শিলান্যাস করেছিলেন, রাজ্যের সেই প্রাক্তন মন্ত্রী তথা রাইপুরের বিধায়ক উপেন কিস্কুর স্বীকারোক্তি, “ওই সেতু তৈরির কাজে প্রথম থেকেই গড়িমসি করেছে সেতু নির্মাণকারী কোম্পানীটি। আমাদেরও কিছুটা ব্যর্থতা ছিল।” সেতু তৈরির বরাতপ্রাপ্ত ঠিকা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজার জানিয়েছেন, টেন্ডারের পরে রড, সিমেন্ট-সহ কাঁচামালের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ওই টাকায় কাজ শেষ করা যায়নি। টাকা না বৃদ্ধি করায় কাজ বন্ধ করতে হয়েছিল।
মহকুমাশাসক (খাতড়া) শুভেন্দু বসু অবশ্য বলেন, “জেলা উন্নয়ন কমিটির বৈঠকে ওই সেতুর কাজ অবিলম্বে শুরু করার জন্য একাধিকবার রাজ্য পূর্ত দফতরকে (সড়ক) বলা হয়েছে।’’ বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী এই সেতুর কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। পুজোর পরেই কাজ শুরু করা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।”
—ফাইল চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy