Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও জারি কয়লা পাচার

দিন নেই, রাত নেই রাস্তা দিয়ে চলছে সারি সারি গরুগাড়ি, সাইকেল। এমনকী, ট্রেন, লরি বা বাসের ছাদও বাদ যায় না। দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবেই অবাধে ‘কালো সোনা’ অর্থাৎ কয়লা পাচার হয়ে আসছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই জেলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে। ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন প্রান্তে। নিশ্চিন্তে বেআইনি খনি থেকে কয়লা চুরি করে তা নানা ভাবে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত খয়রাশোল, কাঁকরতলা, দুবরাজপুর, সদাইপুর ও ইলামবাজার থানা এলাকার মানুষ।

জাতীয় সড়কেই এ ভাবে অবাধে সাইকেলে বোঝাই করে চলছে কয়লা পাচার। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

জাতীয় সড়কেই এ ভাবে অবাধে সাইকেলে বোঝাই করে চলছে কয়লা পাচার। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

দিন নেই, রাত নেই রাস্তা দিয়ে চলছে সারি সারি গরুগাড়ি, সাইকেল। এমনকী, ট্রেন, লরি বা বাসের ছাদও বাদ যায় না। দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবেই অবাধে ‘কালো সোনা’ অর্থাৎ কয়লা পাচার হয়ে আসছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই জেলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে। ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন প্রান্তে।

নিশ্চিন্তে বেআইনি খনি থেকে কয়লা চুরি করে তা নানা ভাবে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত খয়রাশোল, কাঁকরতলা, দুবরাজপুর, সদাইপুর ও ইলামবাজার থানা এলাকার মানুষ। অভিযোগ, ওই পাচার কারবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সমাজবিরোধীরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়েই বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে কাঁচা টাকা আয়ের এই বেআইনি কার্যকলাপ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই পাচারকারীদের রক্ষার ভার নিয়েছেন এক শ্রেণির পুলিশ কর্মীই। সব মিলিয়ে ওই অঞ্চলের অবৈধ কয়লা পাচার বন্ধে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই নির্দেশ থাকুক আর না থাকুক, সমাজবিরোধী, রাজনৈতিক কর্মী আর পুলিশ এই ত্রিবিধ জোটের নিয়ন্ত্রণেই কোটি কোটি টাকার ওই বেআইনি কারবার আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে। অন্তত এমনটাই দাবি এলাকাবাসীর।

এলাকাবাসীর ওই অভিযোগকেই সত্যতা দিল জেলার পুলিশ সুপারের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশ। খয়রাশোলে একটি বেআইনি খনি থেকে কয়লা চুরি করতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে মাওবাদী হানায় তিন জনের নিহত হওয়ার মিথ্যা খবর চাউর করার অভিযোগে দুই সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত ওই দু’জনের এক জন খয়রাশোল থানার তৎকালীন ওসি। অপর জন বীরভূমে রাজ্য গোয়েন্দা শাখা বা ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের (আইবি) অফিসার। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, খয়রাশোল ও তার আশপাশে কয়লার অবৈধ কারবারের বিষয়টি গোপন রাখতেই মাওবাদী হানার খবর ফাঁদা হয়েছিল। যে ঘটনা কয়লা পাচারে সমাজবিরোধী, রাজনৈতিক কর্মী আর পুলিশ এই ‘ত্রয়ী’র জড়িত থাকার অভিযোগকেই স্বীকৃতি দিল বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া যদিও সাফ দাবি করছেন, “অবৈধ কয়লা কারবার বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ করা হয়েছে। বর্তমানে পুরোপুরি না হলেও প্রায় বন্ধ রয়েছে ওই কারবার।” অলোকবাবু এমন দাবি করলেও বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু অন্য কথা বলছে। ঘটনা হল, অত্যন্ত সংগঠিত ভাবে প্রতি দিনই শ’য়ে শ’য়ে গরুগাড়ি, সাইকেল ও অন্য ভাবে পাচার হয়ে চলেছে বিপুল সরকারি সম্পদ। বস্তুত, প্রথম থেকেই এই অঞ্চলে কয়লা পাচার রুখতে পুলিশ বা প্রশাসন কোনও দিক থেকেই তেমন উচ্চবাচ্চ করতে দেখা যায়নি বলেই অভিযোগ। বাম আমলে যে চিত্র দেখা যেত, তৃণমূল সরকার আসার পরেও তার যে খুব একটা বদল হয়নি, তা বুধবারও এলাকায় গিয়ে দেখা গেল। এমনকী, শাসক থেকে বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলই অবৈধ এই কারবারের বিরোধিতায় পথে নামেনি।

বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, আসলে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকির এই কারবার থেকে বিপুল পরিমাণ আয় হয়। সেই টাকার লোভ সামলাতে পারছেন না কোনও পক্ষই। তাই বেআইনি হলেও কারবার চলছেই। এক বাসিন্দার কথায়, “কেবল কয়লা বোঝাই গাড়ি চাপা পড়ে কেউ মারা গেলে প্রতিবাদ হয়। সেটাও সাময়িক। তার পরে টাকার আড়ালে কান্নাও চাপা পড়ে।” গোটা এলাকায় এই কারবার কতটা জাঁকিয়ে বসেছে, একটি উদাহরণেই তা বোঝা যায়। পাচারের কয়লা ওজন করার অত্যাধুনিক তুলাযন্ত্রও বসে গিয়েছে খয়রাশোল, দুবরাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে!

কী ভাবে চলে এই কারবার?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাচারে যুক্ত এলাকার কয়েক জন সাধারণ মানুষ জানালেন, মূলত, বর্ধমানের চুরুলিয়া থেকে অজয়ের বিনুইঘাট পেরিয়ে এবং ঝাড়খণ্ডের নলা থানা এলাকার দেশেরমোহন থেকে কয়লা এসে জড়ো হয় খয়রাশোল ব্লকের কাঁকরতলা থানা এলাকার বড়কোলায়। ঝাড়খণ্ডের পলাশস্থলীতে থাকা ইসিএলের পরিত্যক্ত কয়লা খাদান থেকেও বেশ কিছু কয়লা সেখানে আসে। এর পরে সাইকেল, গরুগাড়ি বোঝাই করে সেখান থেকে বিভিন্ন বেআইনি ‘ডিপো’তে (কয়লা মজুত রাখার জায়গা) তা পৌঁছে দেওয়া হয়। একই ভাবে ঝাড়খণ্ডের বিক্রমপুরে জড়ো হওয়ার পর সেই কয়লা রাজনগরে নিয়ে আসা হয়। এর পরেই বিশেষ ভাবে তৈরি করা গরুগাড়ি (যেগুলি কমপক্ষে আড়াই থকে তিন টন অবধি কয়লা বহন করতে পারে) করে বিভিন্ন পথ ধরে পাচারের কাজ শুরু হয়। বড় অংশই সেরে ফেলা হয় রাতের অন্ধকারে। দিনের আলোতেও গরুগাড়ি চলে। তবে, সংখ্যায় অনেক কম। এ ছাড়াও অসংখ্য সাইকেলে (এক একটিতে চার কুইন্ট্যাল কয়লা বহন করা যায়) করে খয়রাশোল, কাঁকরতলা, দুবরাজপুর, রাজনগরের বিভিন্ন গ্রামের কয়লা কারবারীদের কাছে ওই কয়লা পৌঁছে দেওয়া হয়। ওই পাচারকারীদের দাবি, এ ভাবে কয়লা পাচার করতে প্রথমেই এক শ্রেণির পুলিশকে গাড়ি পিছু মোটা টাকা তোলা দিতে হয়। সেই তোলার পরিমাণ এক একটি গরুগাড়ি বাবদ ৭-৯ হাজার টাকা অবধি হয় বলে তাঁরাই জানাচ্ছেন।

স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই অঞ্চলে আরেক ভাবেও কারবারিরা চোরাই কয়লা বিক্রি করে। খয়রাশোলের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু ফ্যাক্টরি রয়েছে। স্থানীয় মানুষ বা কয়লা কারবারিরা যাকে ‘ফুয়েল’ বলে ডেকে থাকেন। কাঁচা কয়লা খনি থেকে বৈধ কয়লা কিনে সেটিকে পুড়িয়ে ‘কোক কয়লা’ হিসেবে বিক্রির ছাড়পত্র রয়েছে ওই সব ফুয়েলের। কিন্তু অভিযোগ, বৈধ ভাবে কয়লা না কিনে পাচার হয়ে আসা সাইকেল বা গরুগাড়ি বোঝাই কয়লাই ওই সব ফ্যাক্টরি মালিকেরা কিনে থাকেন। এ ক্ষেত্রে মালিকদের যেমন মোটা টাকা আয়ের সুযোগ হয়, তেমনই খুব বেশি পথ পাড়ি দেওয়ার অসুবিধা থেকেও স্বস্তি মেলে পাচারকারীদের। বেআইনি কারবারে যুক্ত হয়ে আইনের কারবারিদের হাত থেকে বাঁচার উপায়ও তাঁরা করে ফেলেছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ ক্ষেত্রেও এক শ্রেণির পুলিশকে মোটা টাকার তোলা দিয়ে ওই মালিকেরা এমন বেআইনি কারবারের ‘ছাড়পত্র’ নিয়ে রেখেছেন।

এ দিকে, পাচার হয়ে আসা কয়লার বাইরেও ওই ব্লকের একটি বেসরকারি খোলামুখ কয়লা খনি সংস্থার কিছু চোরাই কয়লা খয়রাশোলের ভীমগড় এলাকায় আসে। অজয় নদের ও-পারে থাকা পাণ্ডবেশ্বর থেকেও কয়লা এসে সেখানে জড়ো হয়। তবে, এই কয়লা কারবার চলে মূলত সাইকেলে। শ’য়ে শ’য়ে সাইকেল। বহু সাধারণ মানুষ এই অবৈধ কারবারে যুক্ত থেকে দিনে সাইকেল প্রতি ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এ ছাড়া সিউড়ি-আসানসোল রুটের বাসের ছাদে করে এবং পূর্ব রেলের অন্ডাল-সাঁইথিয়া শাখার ট্রেনেও অবৈধ কয়লা আসে। ভীমগড়, পাঁচড়া, দুবরাজপুর, চিনপাই-সহ বিভিন্ন স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে পুলিশের সামনেই তা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সেখান থেকেই কয়লা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলায়।

এই অবৈধ কারবার রুখতে মানুষ তেমন প্রতিবাদ করেন না কেন?

এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের মত, গোটা এলাকায় সমাজের প্রায় সর্বস্তরেই অবৈধ কয়লা কারবারের শিকড় পৌঁছে গিয়েছে। যে, যে ভাবে পারে, তা থেকে রসদ সংগ্রহ করে। তার জেরে প্রতিবাদটাই হারিয়ে গিয়েছে। মেয়ের বিয়ে থেকে স্থানীয় ক্লাবের জলসা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পার্টি ফান্ড কিংবা খেলার আসর সব ক্ষেত্রেই অবৈধ কয়লার মোটা চাঁদা পৌঁছে যায়। ফলে জোরালো প্রতিবাদ হবে, এমনটা আশাও করা যায় না। এলাকার এক যুবকের উক্তিতেই তা স্পষ্ট। তাঁর যুক্তি, “একটু চড়াই পথে কয়লাভর্তি সাইকেল ঠেলে দিনে ৫০০ টাকা আয় হয়ে যায়। অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ টাকা আয় করতে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষকে বহু কাঠখড় পোহাতে হয়।”

রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার প্রসঙ্গ অস্বীকার করেছেন সব দলের নেতারাই। অন্য দিকে, রাজনৈতিক ভাবে এই কারবার রোখার প্রসঙ্গটি অবশ্য অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর বক্তব্য মেলেনি। সিপিএম জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “আমরা দীর্ঘ দিন ধরে ওই এলাকাটি সরকারকে অধিগ্রহণ করার দাবি জানিয়ে এসেছি। সেটা হলে সরকারি উদ্যোগেই স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান হত। তাঁরা আর এ ভাবে চুরি করতেন না। সহজেই সমস্যার সমাধান হত।” কিন্তু বাম বা তৃণমূল, কোনও আমলেই অবশ্য তা বাস্তবায়িত হয়নি। আবার, বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল জানিয়েছেন, ওই এলাকায় সরকারি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। তাই ওই বেআইনি কারবার বন্ধ করতে তাঁরা বদ্ধ পরিকর। তবে, তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ যাঁরা ওই কাজে যুক্ত, তাঁদের বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করেই সমাধান করা হবে। আমরা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে রাজ্য কমিটিতে আলোচনা করেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

coal trafficking cm’s instruction birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE