Advertisement
০৫ মে ২০২৪

স্থায়ী ডোমের অভাবে ধুঁকছে পুলিশ মর্গ

তিন মহকুমার একমাত্র ভরসা ওই তিনটি হাসপাতালই। সেই তিনটিকেই ‘সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল’ স্তরে উন্নীত করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৪ ০৬:২১
Share: Save:

তিন মহকুমার একমাত্র ভরসা ওই তিনটি হাসপাতালই। সেই তিনটিকেই ‘সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল’ স্তরে উন্নীত করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সিউড়ি, বোলপুর ও রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালেরই পুলিশ মর্গে নেই কোনও স্থায়ী ডোম বা শব ব্যবচ্ছেদ কর্মী। কোথাও এক জন কোথাও দু’জন অস্থায়ী ভাবে ওই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত ‘দৈনিক মজুরি হার’কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অস্থায়ী ওই কর্মীদেরও খুব সামান্য বেতনে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

বিষয়টির যিনি দেখভাল করেন, সেই অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) দেবীপ্রসাদ কর্ণম বলেন, “এ ব্যাপারে যা বলার সিএমওএইচ-ই বলবেন।” অন্য দিকে, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডল বলেন, “এই চিত্র রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই। এ ভাবেই জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। অধিকাংশ হাসপাতালেই স্থায়ী ডোম না থাকার জন্য ময়না-তদন্তের কাজ ব্যহত হচ্ছে। কিন্তু আমরাই বা কী করতে পারি! উপরমহলে বহুবার বলার পরেও কিছু হচ্ছে না।”

ডোমেদের কাজটা ঠিক কী?

হাসপাতাল সূত্রে খবর, ডোম ছাড়া কোনও হাসপাতালের পুলিশ মর্গেই মৃতদেহ ময়না-তদন্ত করা হয় না। ময়না-তদন্তের সময় চিকিত্‌সকদের নির্দেশে মৃতদেহ কাটা-ছেঁড়া সেলাই করতে হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের অস্থায়ী ডোমের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন রাজেন ডোম। তাঁর কথায়, “যে কোনও রকম অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ময়না-তদন্তের সময় আমাদের ডাক পড়ে। কীটনাশক খেয়ে মৃতদের ময়না-তদন্ত করার জন্য চিকিত্‌সকের নির্দেশে পেট কেটে পরে সেলাই করতে হয়। গলায় দড়ি দিয়ে মৃত্যুর ময়না-তদন্তের জন্য মৃতদেহের গলা চিঁড়ে পরে সেলাই করতে হয়। দুর্ঘটনায় মৃতদের ময়না-তদন্ত করার জন্য মাথা ফাটিয়ে পরে সেলাই করতে হয়।” আর তিনটি হাসপাতালেই এই সব কাজ করছেন রাজেনদের মতো কিছু অস্থায়ী কর্মীই।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের পুলিশ মর্গের ডোমের দু’টি পদই ফাঁকা। সমস্যার কথা মেনে নিয়ে হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রি হালদার বলেন, “মহকুমাশাসকের দফতর থেকে নিযুক্ত এক অস্থায়ী কর্মীর ভরসাতেই হাসপাতালের ময়না-তদন্তের কাজ চলছে। দিনের পর দিন এ ভাবেই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। শূন্যপদ দু’টিতে স্থায়ী ডোম নিয়োগ করার জন্য একাধিক বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।” এমনকী, তাঁর দাবি, বর্তমানে অস্থায়ী ডোম পদে থাকা অভিজ্ঞ রাজেনবাবুকে স্থায়ী ভাবে নিয়োগ করার জন্যও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মহকুমাশাসক ও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে আবেদন করা হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত পদক্ষেপ করা হয়নি। রাজেনবাবু বলেন, “২০০৯ সালে পোস্টমর্টেম ওয়ার্কার পদে (শব ব্যবচ্ছেদ কর্মী) নিয়োগের জন্য জেলাশাসকের (সাধারণ) অফিসে এবং সিউড়ি সদর হাসপাতালে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত কাউকেই নিয়োগ করা হয়নি।”

একই চিত্র সিউড়ি সদর ও বোলপুরেও। সিউড়ি সদর হাসপাতালে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে দু’টি ডোম পদই শূন্য পড়ে রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতেই আবার এক জন অবসর নিয়েছেন। হাসপাতালের অসিত বিশ্বাস বলেন, “খুবই খারাপ অবস্থা। কোনও রকমে এক জন অস্থায়ী কর্মীকে দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছি।” দু’টি পদ শূন্য বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানে এক জন অস্থায়ী ভাবে ডোমের কাজ করছেন। অসহায় হয়ে হাসপাতাল সুপার প্রদীপ মজুমদার বললেন, “স্থায়ী না অস্থায়ী জানি না। আমার লোক দরকার। এ ভাবে কাজ চালানো যায় না।”

প্রশাসন সূত্রে খবর, সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত কাজ করেও সরকারি বেতন কাঠামোয় ওই অস্থায়ী ডোমেরা বেতন পান না। এমনকী, সরকার নির্ধারিত দৈনিক মজুরি হার (‘ডেলি রেটেড ওয়েজেস’) অনুযায়ীও (প্রতি মাসে ৬, ৫০০ টাকা) তাঁদের বেতন দেওয়া হয় না বলেই অভিযোগ। প্রতিটি মৃতদেহ ময়না-তদন্তের সময় শবচ্ছেদ করার জন্য তাঁরা পান মাত্র ৬৮ টাকা। এ ছাড়া ময়না-তদন্ত হয়ে যাওয়া দাবিহীন মৃতদেহ মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দেওয়ার জন্য ডোমেদের দেহ পিছু মাত্র ৭১ টাকা করে দেওয়া হয়। ফলে কখন মৃতদেহ আসে, তারই প্রতীক্ষায় হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরের সামনে হাপিত্যেস করে বসে থাকেন রাজেনরা। তাঁর কথায়, “মাসে গড়ে ৩০টি মৃতদেহ ময়না-তদন্ত হয়। হিসেব অনুযায়ী মাসে দু’ থেকে আড়াই হাজার টাকা মেলে। সেই টাকাও মেলে তিন-চার মাস অন্তর। সংসার চালাতে দম বেরিয়ে যায়।”

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী স্পষ্টই বলছেন, “রাজ্যের বহু হাসপাতালেই ডোম নিয়ে সঙ্কট রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি স্বরাষ্ট্র দফতরের। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই।” মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা ওই দফতরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE