Advertisement
০১ মে ২০২৪

সুনসান সিপিএম, সরগরম তৃণমূল পার্টি অফিস

দৃশ্য ১: লোকপাড়া। সকাল ১০টা। একচোট ধুলো জমেছে বাইরের দরজায়। ধুলোর আস্তরণ বাইরে কর্মীদের বসার কংক্রিটের বেঞ্চেও। ঝাঁট পড়েনি দীর্ঘ দিন। দৃশ্য ২: খুজুটিপাড়া। বিকেল ৩টে। কার্যত ভগ্নস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ দিন সেখানে কারও পা পড়েনি।

আজও তৈরি হয়নি গত লোকসভা ভোটের পরে খুজুটিপাড়ায় পুড়ে যাওয়ায় সিপিএমের পার্টি অফিস।

আজও তৈরি হয়নি গত লোকসভা ভোটের পরে খুজুটিপাড়ায় পুড়ে যাওয়ায় সিপিএমের পার্টি অফিস।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৪ ০১:৪৪
Share: Save:

দৃশ্য ১: লোকপাড়া। সকাল ১০টা। একচোট ধুলো জমেছে বাইরের দরজায়। ধুলোর আস্তরণ বাইরে কর্মীদের বসার কংক্রিটের বেঞ্চেও। ঝাঁট পড়েনি দীর্ঘ দিন।

দৃশ্য ২: খুজুটিপাড়া। বিকেল ৩টে। কার্যত ভগ্নস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ দিন সেখানে কারও পা পড়েনি।

উপরের ওই দুই চিত্রই সিপিএমের দু’টি দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোকাল কমিটি অফিসের। এক সময় দলের তাবড় তাবড় সব নেতারা এমন সব পার্টি অফিস থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে ভোট সবই পরিচালনা করতেন। দিনভর আড্ডা থেকে নানা বৈঠকে সরগরম হয়ে থাকত ওই পার্টি অফিস। বিশেষ করে নির্বাচনে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়গুলিতে তৎপরতা থাকত তুঙ্গে। দেখা যেত অফিসের ভিতরে এককোনে স্টোভের উপর চায়ের জন্য জল ফুটছে। দলীয় প্রচার সভা কিংবা মিটিংয়ের ফাঁকে চায়ে গলা ভিজিয়ে নিতেন কর্মী-সমর্থকেরা। আবার কোথাও বা দুপুরের প্রচার অভিযানে বেরোনের আগে দলীয় প্রার্থী এবং কর্মী-সমর্থক ও অনুগামীদের জন্য ভাতের হাঁড়িও চাপত।

সেই ছবিটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। এ বারের লোকসভা ভোটের মুখে এখনও পর্যন্ত ওই সব দলীয় কার্যালয়ে আঁধার ছাড়া আর কিছুই নজর পড়ছে না। জেলা সিপিএমের হিসেবে, জেলায় এই মুহূর্তে দলের দশটিরও বেশি পার্টি অফিস বন্ধ। কোথাও নিয়ম করে কার্যালয় খোলা হলেও, সেখানে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের দেখা নেই বললেই চলে। ফলে ভোটের মুখে ওই সব এলাকায় তাদের কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপই নজরে পড়ছে না। আবার ঠিক উল্টো চিত্র শাসক দলের পার্টি অফিসগুলিতে। এই পরিস্থিতিতে ভোট প্রচারে পুরনো কৌঁশলকেই হাতিয়ার করছে জেলা সিপিএম। ক্ষমতায় আসার আগে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকদের গোপনে রাতের অন্ধকারে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে প্রচার সারতে হত। জেলার বেশ কিছু এলাকায় এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই পুরনো কৌঁশলই বেছে নিয়েছে সিপিএম। দলের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “তৃণমূলের সন্ত্রাসে হিংলো, বাতিকার, গদাধরপুর, ঢেকা, কান্তোর, উত্তর কোপাই, খুজুটিপাড়া-সহ জেলার ১০-১২টি কার্যালয় আমরা দীর্ঘ দিন ধরে খুলতে পারছি না। ওই সব এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি করার ক্ষেত্রে তাই তৃণমূলের সন্ত্রাসের একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসার আগে যে ভাবে রাতের অন্ধকারে মিটিং করে কর্মসূচি নেওয়া হত, ঠিক সে ভাবেই আমরা ভোট প্রচার সারছি।”

জমজমাট তৃণমূল কার্যালয়।

অথচ বছর চারেক আগেও জেলার অধিকাংশ এলাকাতেই তৃণমূলের তেমন কোনও দলীয় কার্যালয় ছিল না বললেই চলে। নেতাদের বৈঠক খানা কিংবা কোনও পোড়ো বাড়িতে নির্বাচনী কাজ সারতে হত। অন্য দিকে, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলি, বিশেষ করে সিপিএমের জেলার বিভিন্ন স্থানে জোনাল, লোকাল এবং শাখা কার্যালয় ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল। সে দিক থেকে দেখতে গেলে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় হওয়া ‘সূচপুর গণহত্যা’র জেরে মেলা সহানুভূতির হাওয়াকে পালে লাগিয়েই লালমাটির বীরভূমে তৃণমূলের উত্থান। সূচপুর নওয়ানগর-কড্ডা পঞ্চায়েতের অধীন ওই পঞ্চায়েতের খুজুটিপাড়াতেই সিপিএমের লোকাল কমিটির অফিস। সেখান থেকেই সিপিএমের প্রভাবশালী নেতা নিত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় নানুর থানা এলাকায় দলের বিভিন্ন কর্মসূচি তথা নির্বাচন পরিচালনা করতেন। কিন্তু হাওয়া ঘুরে যায় ২০১০ সালে। ওই সময়ে সূচপুর গণহত্যা মামলায় নিত্যবাবু-সহ ৪৪ জন সিপিএম নেতা-কর্মী যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে জেলে যান। ২০১১ সালের নির্বাচনেই লালদুর্গ হিসেবে খ্যাত নানুর বিধানসভা কেন্দ্রটিও তৃণমূল ছিনিয়ে নেয়। গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের একটি আসন ছাড়া পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১১টি পঞ্চায়েতের কোথাও প্রার্থী দিতে পারেনি বামফ্রন্ট। ২০১১ সালের নভেম্বরেই খুজুটিপাড়ায় সিপিএমের কার্যালয়টি পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তার পর থেকেই ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে এক সময় কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে সরগরম হয়ে থাকা ওই পার্টি অফিস।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কার্যালয় লাগোয়া এক চা-তেলেভাজার দোকানদার বললেন, “বছর চারেক আগেও ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সরগরম হয়ে থাকত পার্টি অফিস। ঘনঘন পছন্দ অনুযায়ী চা কিংবা তেলেভাজা মুড়ির অর্ডার আসত। মাসের শেষে একটা মোটা রোজগারও হত। কিন্তু এখন তো সব শুনসান।” একটু এগিয়েই দেখা মিলল এলাকার এক পুরনো সিপিএম কর্মীর। পরিবর্তনের জমানায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “এখানেই দুপুরে প্রচারে বের হওয়ার আগে প্রার্থী এবং তাঁর প্রচার সঙ্গীদের রান্না করে খাওয়ানো হত। আবার আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে লেবু চা-ও তৈরি করা হত। এখন ওই সব বাসনপত্রেও মনে হয় এক প্রস্থ ধুলো জমে গিয়েছে।”

অন্য দিকে, উল্টো চিত্র দেখা গেল তৃণমূলের বিভিন্ন কার্যালয়ে। দলের ময়ূরেশ্বর থানার ঢেকা অঞ্চল কমিটির অফিসে সকাল ৮টাতেই ব্যস্ততা তুঙ্গে। দেওয়াল লিখনের জন্য পেশাদার শিল্পীরা রং গুলে প্রস্তুত হচ্ছেন। তদারকিতে থাকা অঞ্চল যুব সভাপতি প্লাবন মণ্ডল বললেন, “পঞ্চায়েতের ৪২টি গ্রামেই দেওয়াল লিখন প্রায় শেষ। গ্রামে গ্রামে জমিয়ে কর্মী সভাও চলছে।” একই ভাবে তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যালয়ে চরম ব্যস্ত দেখাল দলের ব্লক কার্যকরী সভাপতি অশোক ঘোষকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কর্মী-সমর্থকদের হাতে ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন কোথায় কীভাবে সেগুলি টাঙাতে হবে। তাঁর দাবি, “গত লোকসভা থেকেই হাওয়া ঘুরে গিয়েছে। সিপিএম বলতে এলাকায় কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের বিধানসভা এলাকা থেকে দলীয় প্রার্থীকে রেকর্ড লিড দেব।” এমন সুখের দিনে স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএমকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। সন্ত্রাসের অভিযোগ নস্যাৎ করে তাঁর মন্তব্য, “সিপিএম আসলে পার্টি অফিস খোলার লোক পাচ্ছে না। তার জন্য আমরা কী করতে পারি! তবে, ওঁরা যদি চান তা হলে পার্টি অফিস খোলার জন্য আমরাই লোক সরবরাহ করে দেব। প্রচারের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করব।”

সিপিএমের জেলা সম্পাদক অবশ্য দাবি করছেন, মানুষ শান্তিতে ভোট দিতে পারলে তাঁদের জয় সুনিশ্চিত। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “যে যতই গর্জন করুন না কেন, গত আড়াই বছর ধরে রাজ্য জুড়ে ধর্ষণ, সারদা থেকে টেট সর্বত্র কেলেঙ্কারি ও বিশ্ৃঙ্খলার কথা মানুষ ভুলে যাননি। উন্নয়নের গল্প দেওয়া তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার জবাব মানুষ ভোট-বাক্সেই দিয়ে দেবেন।” লোকসভা ভোটের ফলের কী হয়, তা জানতে এখনও ঢের দেরি। তার আগে আপাতত অতীতকে হাতিয়ার করেই ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টায় সিপিএম।

ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

argha ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE