এই সেই শিল্প স্মৃতির চিমনি।—নিজস্ব চিত্র।
খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ বীরভূমের অন্যতম শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিত মহম্মদবাজার। প্রাচীন সেই শিল্প স্মৃতির চিমনি আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লোহাবাজারে। জনশ্রুতি, বহু আগে মহম্মদবাজারের আকরিক লোহার যথেষ্ট কদর ও সুনাম ছিল। দেশ বিদেশের বহু রাজা, জমিদার, বাঙালি বিত্তবান এমনকী কলকাতার ‘মেসার্স ম্যাকে এন্ড কোম্পানি’-র মতো কোম্পানিও মহম্মদবাজার এলাকায় লৌহ উত্পাদন ও লৌহ কারখানা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ক্রমে আধুনিক যন্ত্রপাতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা-সহ নানা সমস্যার কারণে সেই শিল্প যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। এরই মাঝে, অর্থনীতির আরও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা প্রকল্পের ঘোষণায়।
লৌহ শিল্প সুবর্ণ সময়ের পর, মহম্মদবাজার এলাকা ফের শিল্পের সুখ্যাতি অর্জন করতে থাকে। প্রথমে খড়ি মাটি ও পরে পাথরের মাধ্যমে। এখন খড়িমাটি ও পাথর দুটি শিল্পেরই রমরমা। ১৯৫০ এ তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, বল্লভভাই প্যাটেলের নামে মহম্মদবাজার টাউনশিপ ‘প্যাটেলনগর’ তৈরি করেন।
প্রবীণ বাসিন্দা ফাইজল শেখ ও লোহাবাজারের বাসিন্দা সুনীতি মণ্ডলরা বলেন, “বাবা ঠাকুরদার মুখে আকরিক লৌহর খনি ও কারখানার গল্প শুনেছি। চার পাঁচশো বছর আগেও মহম্মদবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় লৌহ আকরিক পাওয়া যেত। এলাকায় নানা জায়গায় লোহার টুকরো পড়েও থাকত।” এলাকার কাঁচা লোহার কারিগরদের বলা হত শাশা। শাশাদের সকলেই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। অন্যদিকে পাকা লোহার কারিগরদেরকে ‘মেহতর’ বলা হত। তাঁরা আবার সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন।
১৭৬৫ সালে বীরভূমের লৌহখনি অঞ্চল ‘লোহা মহাল’ নামে একটি পৃথক মহালে পরিণত হয়। এই মহালের ইজারাদার ছাড়াও উত্পাদনের প্রায় সর্বস্তরে পাঠান রাজারা অল্প বিস্তর শুল্ক ধার্য করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত লোহার উত্পাদন ব্যবসা বেশ জমজমাট ছিল। এরই মধ্যে ১৭৭৪ সাল নাগাদ ইন্দ্রনারায়ন শর্মার বীরভূমের লৌহশিল্পে পা রাখেন। ফের আশার আলো জাগায় লৌহশিল্পে। ১৭৭৯ সালে ‘মেসার্স মট এন্ড ফার্কুহার’ দেউচায় কামান ও গোলাগুলির ঢালাইয়ের কারখানা স্থাপন করেন। নানা কারণে ১৭৮৯ সালে বীরভূমের সেই কারবার তাঁরা তুলে দেন। সেদিক থেকে বলা যায়, মহম্মদবাজারে ১৮৫৫ সালে কলকাতার ‘মেসার্স ম্যাকে এ্যন্ড কোম্পানী’র ‘বীরভূম আয়রণ ওয়ার্কস কোম্পানী’ জেলায় শিল্পপুঁজি ভিত্তিক প্রথম শিল্পোদ্যোগ। কিন্তু লোকসানে চলতে থাকায়, কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দেয় ম্যাকে। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ডেউচা কারখানার একটি বৃহত্ চুল্লি কোনওরকমে টিকে থাকে। চার পাঁচ পর ইংরেজ প্রতিষ্ঠান ‘বার্ণ এ্যন্ড কোম্পানী’ লৌহ কারখানার কাজ শুরু করে।
কিন্তু লোকসানের গন্ধ পেতেই, তারাও বছর দশেকের মধ্যে কারবার তুলে কলকাতায় পাড়ি দেয়। এ সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় রঞ্জন গুপ্তর লেখা ‘রাঢ়ের সমাজ অর্থনীতি ও গণবিদ্রোহ’ বইয়ে। আসলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে সময়।
বার্ণ কোম্পানির কারখানাকে কেন্দ্র করে মহম্মদবাজারের একটি এলাকার নামই হয়ে যায় লোহাবাজার। কোম্পানির ছেড়ে যাওয়া জায়গায় বসতি তৈরি হয়। বর্তমানে শিক্ষক শ্রীজিত্ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বার্ণ কোম্পানির একটি চিমনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জাতীয় সড়ক নির্মাণের সময় তাঁর বাড়ির উল্টোদিকের বড় চিমনিটি ভাঙা যায়। মহম্মদবাজারের শিল্প উদ্যোগী স্বপন ঘোষের কথায়, “মহম্মদবাজারে নতুন শিল্পের জন্ম দেন শিবদাসবাবু। বিস্তীর্ণ এলাকায় লৌহ আকরিক পাওয়া যেত। এলাকায় লোহার টুকরো ও স্লাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেত। এখন গল্প কথা।”
মূলত এই দুই শিল্প ঘিরেই এলাকার বহু মানুষ কাজ পায়। নব্বইয়ের দশকে জাতীয় সড়ক হওয়ার পর, এলাকার শিল্প সম্ভবনা উজ্জল হয়ে ওঠে। বিধান চন্দ্র রায়ের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে মহম্মদবাজার ও আঙ্গারগড়িয়া মৌজায় ১৭০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল মেমোরিয়াল ফান্ডের টাকায় নির্মাণ হয় মহম্মদবাজার টাউনশিপ। ৩০০-র মত গৃহ নির্মাণ করা হয়। বদলে যাওয়া এই নতুন সময়ের মহম্মদবাজার এখনও স্বপ্ন দেখে, জেলার এই শিল্প-নগর ফের ঘুরে দাঁড়াবে।
মহম্মদবাজারের বিডিও সুমন বিশ্বাস বলেন, “লৌহ শিল্প বন্ধ হলেও, খড়িমাটি ও পাথর শিল্প এই এলাকার শিল্প সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে। কয়লা নিয়েও ইতিমধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে।” ডিএম পি মোহন গাঁধী বলেন, “লৌহ, খড়িমাটি, পাথর ও কয়লায় সমৃদ্ধ এমন জেলা দেখা যায় না। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে খনিজ তেল পাওয়ারও একটা সম্ভবনা আছে। ওএনজিসি দীর্ঘদিন থেকে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy