Advertisement
০৬ মে ২০২৪
পরীক্ষার্থীদের জন্য ‘এলিফ্যান্ট স্কোয়াড’

সামনে হুলা পার্টি, পরীক্ষার পথে ওরা

দুরুদুরু বুকে শাল জঙ্গল চেরা লাল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে ভীতু কিছু মুখ। কেউ হেঁটে, কেউ কেউ সাইকেলে। বাঁকুড়ার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির খুবই পরিচিত ছবি। এই সব গ্রামের স্কুলপড়ুয়া বছরভর স্কুলে যাতায়াত করে বুকে ভয় নিয়ে। ভয়, হাতি ঠাকুরের! কখন যে জঙ্গলের ভিতর থেকে সামনে এসে পড়বে দাঁতাল, জানে না কেউই। এত দিন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সময়ও হাতির ভয় মনে নিয়েই পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে তাদের।

পরীক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার পথে হুলাপার্টির কর্মীদের অপেক্ষা। পাথরায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

পরীক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার পথে হুলাপার্টির কর্মীদের অপেক্ষা। পাথরায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
সোনামুখী শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৮
Share: Save:

দুরুদুরু বুকে শাল জঙ্গল চেরা লাল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে ভীতু কিছু মুখ। কেউ হেঁটে, কেউ কেউ সাইকেলে।

বাঁকুড়ার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির খুবই পরিচিত ছবি। এই সব গ্রামের স্কুলপড়ুয়া বছরভর স্কুলে যাতায়াত করে বুকে ভয় নিয়ে। ভয়, হাতি ঠাকুরের! কখন যে জঙ্গলের ভিতর থেকে সামনে এসে পড়বে দাঁতাল, জানে না কেউই। এত দিন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সময়ও হাতির ভয় মনে নিয়েই পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে তাদের। এ বার অবশ্য মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সেই ভয় কাটাতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে বাঁকুড়া (উত্তর) বন বিভাগ। জেলায় এই প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনগুলিতে পরীক্ষার্থীদের জঙ্গলের রাস্তা নিরাপদে পার করে দেওয়ার জন্য ‘এলিফ্যান্ট স্কোয়াড’ পাঠাচ্ছে ওই বন বিভাগ। তবে, এই ব্যবস্থা আপাতত সোনামুখী রেঞ্জের পাথরা গ্রামের পরীক্ষার্থীদের জন্য।

ডিএফও (বাঁকুড়া উত্তর) সুধীরচন্দ্র দাস বলেন, “হাতির দল রয়েছে ওই রেঞ্জের জঙ্গলে। তাই ওই গ্রামের পরীক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এলিফ্যান্ট স্কোয়াড তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকের পরে উচ্চ মাধ্যমিকেও পরীক্ষার দিনগুলিতে প্রয়োজনীয় গ্রামে এই স্কোয়াড যাবে। জেলায় এমন উদ্যোগ প্রথম।” বন দফতর সূত্রের খবর, এই উদ্যোগের কথা তারা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিল। জেলাশাসকের নির্দেশে সোনামুখী ব্লক প্রশাসন পরীক্ষার্থীদের পাকা রাস্তা অবধি পৌঁছে দিতে গাড়ির বন্দোবস্ত করেছে।

বাঁকুড়ার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে ফি-বছর বাড়ছে হাতির হামলা। বাড়ছে হাতির আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যাও। বন দফতর সূত্রের খবর, শুধুমাত্র সোনামুখী রেঞ্জেই পুজোর পর হাতির হামলায় তিন গ্রামবাসী মারা গিয়েছেন। এই নিয়ে সম্প্রতি অশান্ত হয়ে উঠেছিল সোনামুখী শহর। উত্তেজিত জনতা আগুন ধরিয়ে দেয় রেঞ্জ অফিসে। জখম হয়েছিলেন কয়েকজন বনকর্মীও। সেই উত্তেজনায় রাশ টানতে রাজ্যের বন কর্তাদের উপস্থিতিতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষার সময় ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য ‘এলিফ্যান্ট স্কোয়াড’ সেই উদ্যোগেরই অঙ্গ বলে গ্রামবাসীদের ধারণা। সোনামুখী রেঞ্জের অধীন পাথরা গ্রামে সোমবার, পরীক্ষার প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে এই কর্মকাণ্ড।

“এ বার সরস্বতী পুজোর সময় এই জঙ্গলের রাস্তায় আমাদের গ্রামের গোপী নন্দী নামে
এক জনকে আছড়ে মেরেছে হাতি। সেই থেকে ভয় আরও বেড়েছে। ভাগ্যিস হুলা পার্টির
কাকুরা এগিয়ে এসেছেন। ওঁরা থাকায় ভয় কিছুটা ভেঙেছে।” পাথরা গ্রামের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

বেলিয়াতোড়, বড়জোড়া বা গঙ্গাজলঘাটির মতো এই বন বিভাগের হাতি-উপদ্রুত রেঞ্জের গ্রামগুলিতে কেন এই ব্যবস্থা করা হল না? এ প্রশ্নের জবাবে ডিএফও জানান, ওই সব রেঞ্জে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে নিয়মিত বন দফতরের টহলদারি চলছে। কিন্তু, সোনামুখীতে সাম্প্রতিক সময়ে হাতির হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষার্থীরা নিজেদের গ্রামে জড়ো হচ্ছেন। তাদের তুলে নেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের পাঠানো গাড়িতে। সামনে আর একটি গাড়িতে থাকছেন হাতি তাড়ানোর হুলা পার্টির সদস্যেরা। তাঁরাই জঙ্গলের রাস্তা নির্বিঘ্নে পার করাচ্ছেন পড়ুয়াদের। মঙ্গলবার জঙ্গল ঘেঁষা গ্রাম পাথরায় গিয়ে দেখা গেল, পরপর দু’টি গাড়ি দাঁড়িয়ে। পিছনের গাড়িতে ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে ১২ জন পরীক্ষার্থী। গাড়িতে ওঠার আগে সকলের কপালে হাত। সঙ্গে প্রার্থনা, ‘তোমার (হাতি ঠাকুর) সামনে যেন না পড়ি!’

দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মোরাম বিছানো পাঁচ কিলোমিটার পথ পার হয়ে বিষ্ণুপুর-সোনামুখী রাস্তার উপর পাথরমোড়া গ্রামে নামিয়ে দেওয়া হল পরীক্ষার্থীদের। হাঁফ ছাড়লেন হুলা পার্টির নেতা রামেশ্বর হাঁসদা। তাঁর টিমে সদস্য দশ জন। হাতে কেরোসিনের টিন। সঙ্গে হুলা আর মশাল। রামেশ্বর বললেন, “পরীক্ষা শেষ হলে এখান থেকে আবার এদের পৌঁছে দিতে হবে গ্রামে।”

জঙ্গলের পথ ছেড়ে ফের কপালে হাত ছোঁয়াল পলি কুণ্ডু, কৌশিক নন্দী, পূজা পাল, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা রায়, মিতা গায়েনরা। এখান থেকে বাস ধরে কেউ যাবে রাধানগর গ্রামের পরীক্ষাকেন্দ্রে। কেউ বা সোনামুখী সদরে। পলির কথায়, “এ বার সরস্বতী পুজোর সময় এই জঙ্গলের রাস্তায় আমাদের গ্রামের গোপী নন্দী নামে এক জনকে আছড়ে মেরেছে হাতি। সেই থেকে ভয় আরও বেড়েছে। ভাগ্যিস হুলা পার্টির কাকুরা এগিয়ে এসেছেন। ওঁরা থাকায় ভয় কিছুটা ভেঙেছে।” পলির জ্যাঠা দয়াময় কুণ্ডু বলেন, “বন দফতরের এই উদ্যোগ ভাল। তবে, শুধু পরীক্ষার সময় কেন, সব সময় থাকা উচিত। কারণ, বছরভরই এই জঙ্গলে বুনো হাতি থাকে। আর তাদের উত্‌পাতে আমাদের জীবন জেরবার।”

বড়জোড়ার গদারডিহি গ্রামের স্কুলছাত্রী শিল্পী কর্মকার বছর দুয়েক আগে তাঁর এলাকা থেকে হাতি তাড়ানোর দাবি জানিয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনিও লিখেছিলেন, রোজ স্কুলে যাতায়াতের পথে তিনি ভয়ে থাকেন, কখন সামনে হাতি এসে পড়বে! শিল্পী এখন কলেজে পড়েন। বন দফতরের পদক্ষেপের কথা জেনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। ওই সব রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করাটা কতটা ঝুঁকির, তা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি। হাতির তো আর দিনরাত নেই। যে কোনও সময় ওরা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। অন্তত পরীক্ষার দিনগুলোতে ওই ছেলেমেয়েরা যে কিছুটা নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারবে, সেটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swapan bandyopadhyay sonamukhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE