ডুয়ার্সে তিন রাত, চার দিনের জন্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের একটি রিসর্টে উঠেছিল কলকাতার দু’টি পরিবার। প্রথম দিনটা বাদ দিয়ে রোজ দুপুরে তারা খেতে যেত মালবাজারে, ১৬ কিলোমিটার উজিয়ে। তাদের বক্তব্য, রিসর্টে মাছের ঝোল বলে যা দেওয়া হয়, তা হাসপাতালের পথ্য হিসেবে বেশি মানানসই।
শুধু ওই রিসর্ট নয়, নিগমের বহু লজেই সুস্বাদু খাবার মেলে না বলে অভিযোগ পর্যটকদের। তাই খাবারের স্বাদ ভাল করতে ও মেনুতে বৈচিত্র্য আনতে উত্তরবঙ্গের তিনটি আর দক্ষিণবঙ্গের তিনটি লজের মোট ছ’জন রাঁধুনিকে সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা সম্প্রতি হয়েছিল কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। নিগমের তরফে এমন উদ্যোগ এই প্রথম।
কিন্তু বাঙালি খানার রন্ধনশৈলীই যাঁদের অনেকের ঠিকঠাক জানা নেই, তাঁদের কয়েক জন চিকেন স্টেক, টোম্যাটো-মাখন-লাল লঙ্কার মটন গোস্ত, কিংবা মাছের ফিলের গায়ে কর্নফ্লেক্স-এর গুঁড়ো মাখিয়ে মুচমুচে ফিশ অ্যান্ড চিপ্স তৈরি শিখে কী ভাবে ভাল পরিষেবা দেবেন, তা নিয়ে নিগমের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। সংশয় প্রকাশ করেছেন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত, এমন লোকজনও। এঁদের বক্তব্য, বিষ্ণুপুরে পোস্তর বড়া, দিঘায় ইলিশ ভাপা-পমফ্রেটের ঝাল, মূর্তির রিসর্টে নদীর ছোট মাছের চচ্চড়ি ছেড়ে অন্য খাবার কলকাতা বা অন্য শহর থেকে যাওয়া লোকজন কেন পছন্দ করবেন?
নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন (থ্রি হর্সমেন অব দ্য নিউ অ্যাপোক্যালিপ্স), ‘বাঙালির অবক্ষয়ের চিহ্ন হিসেবে তার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কী খাচ্ছে এবং কী ভাবে খাচ্ছে, এই দু’টো ব্যাপারেই তারা প্রচণ্ড রক্ষণশীল ছিল। যে দিন তারা ভাত না খেয়ে আরও গুরুপাক খাবার লুচি দিয়ে তরকারি-মিষ্টি দই ও মিষ্টি খেত, সেটা তাদের কাছে ছিল উপবাসের দিন। আর সেই বাঙালিই এখন তৃপ্তি সহকারে দক্ষিণ ভারতীয় বড়া আর ইডলি খায়...।’
নিগমের পাচকদের প্রন বল আর চিকেন ললিপপ বানানোর তালিম দেওয়া কি সেই অবক্ষয়ের চরম রূপ?
ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটর্স কাউন্সিলের সভাপতি শুদ্ধব্রত দেব বলছেন, ‘‘আসলে এ সব দিশাহীন পরিকল্পনার পরিণাম।’’ তাঁর বক্তব্য, সনাতন, আটপৌরে বাঙালি খাবারের জন্যও পর্যটকদের গন্তব্য হতে পারত নিগমের লজগুলি। যেমন বহু ভোজনরসিকের প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজ। সপ্তাহান্তের শনি-রবি দু’দিন রোজ দুপুরে গড়ে ২০০ জনের পাত পড়ে সেখানে। নিগম সূত্রের খবর, ওই ২০০ জনের মধ্যে অন্তত ১৮৫ জন, এমনকী অবাঙালিরাও চান ঘরোয়া বাঙালি খাবার।
সে ক্ষেত্রে বাঙালি রান্নার জন্য প্রসিদ্ধ, জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা নামজাদা পাইস হোটেলগুলির ওস্তাদ ঠাকুরদের কাছে কি লজের রাঁধুনিরা পাঠ নিতে পারতেন না? রাজ্যের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বলছেন, ‘‘আমাদের লজ বা রিসর্টের জন্য শুধু রেসিপিটা শিখলেই কিন্তু হবে না। পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি, আদবকায়দা এগুলোও শিখতে হবে। পাইস হোটেলে ওটা হবে না।’’ কিন্তু তাই বলে পাঁচতারা তালিম কি আদৌ কাজে আসবে? অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম-এর আহ্বায়ক রাজ বসুর মতে, পাঁচতারার সরঞ্জাম, বাসন, উপকরণ নিগমের লজে জোগাড় করা যাবে না। ফলে ওখান থেকে শিখে আসা অবাঙালি রান্না নিগমের হেঁসেলে বিদঘুটে আকার নিতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। তাঁর কথায়, ‘‘খাঁটি বাঙালি রান্নার ঐতিহ্য বাংলার ট্যুরিস্ট লজে ফেরাতেই হবে। লজে এলাকার বিশেষ খাবারকেও রাখা দরকার। যেমন, রায়গঞ্জে তুলাইপাঞ্জি চাল, মালদহে সোনামুগ ডাল, জলদাপাড়ায় বোরোলি মাছ।’’
তালিম দেবেন কারা?
শুদ্ধব্রতবাবুর মত, ‘‘ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মহিলাদের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে।’’ তবে সবার আগে তাঁর প্রস্তাব, ‘‘নিগম আগে নিজেদের কয়েক জন রাঁধুনিকে বেছে নিক। তাঁরা তথ্য জোগাড় করুন, কোন কোন ভাল খাবার কোথায় কোথায় পাওয়া যায়। এর পর তাঁরা নিজেরা সে সব চেখে ঠিক মতো রাঁধুন, অন্য পাচকদেরও শেখান।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy