Advertisement
০৬ মে ২০২৪

অভিযোগ খুঁড়ে বেরোচ্ছে ধন্দ, প্যাঁচে রাজারাম

সাপের হাতি গেলার মতো অবস্থা হয়েছে রাজারাম শরাফের! রাজারামবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতেই বিধাননগরের পুলিশ প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানকে গ্রেফতার করেছে। যদিও লিখিত নালিশটি রাজারামবাবু নিজে করেননি, তাঁর হয়ে পুলিশের কাছে আসিফের বিরুদ্ধে লিিখত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাঁরই সংস্থার কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ। কিন্তু সেই অভিযোগেরই বয়ানের জেরে রাজারামবাবু এখন ঘোর ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছেন।

রাজারাম শরাফ

রাজারাম শরাফ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

সাপের হাতি গেলার মতো অবস্থা হয়েছে রাজারাম শরাফের!

রাজারামবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতেই বিধাননগরের পুলিশ প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানকে গ্রেফতার করেছে। যদিও লিখিত নালিশটি রাজারামবাবু নিজে করেননি, তাঁর হয়ে পুলিশের কাছে আসিফের বিরুদ্ধে লিিখত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তাঁরই সংস্থার কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ। কিন্তু সেই অভিযোগেরই বয়ানের জেরে রাজারামবাবু এখন ঘোর ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছেন। এমনকী, সোমবার কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর তদন্তকারীদের সামনে তাঁকে হাজিরাও দিতে হয়েছে। আইনজীবীদের একাংশের অভিমত, রাজারামবাবু ওই অভিযোগ করে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন।

আসিফের বিরুদ্ধে ওঁদের আনা অভিযোগের মূল বক্তব্য: রাজারহাটে তিনশো বিঘে (১২০ একর) জমি কেনার জন্য জমি-মালিকদের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয়েছে। ওই তল্লাটেই আরও একশো বিঘে (৪০ একর) কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। রাজারামের দাবি, তিনশো বিঘের জন্য কাঠাপিছু আড়াই লক্ষ টাকা হিসেবে চুক্তি হয়েছে, যার কিছুটা তিনি মিটিয়ে দিয়েছেন। বাকি একশো বিঘে হাতে পেতে তিনি আট কোটি টাকা আসিফকে দিয়েছিলেন, যা আসিফ তাঁকে ঠকিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

আসিফের গ্রেফতারি এই অভিযোগের ভিত্তিতেই। কিন্তু রাজারামবাবু কেন বিপাকে পড়লেন?

ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আইনজীবীদের অনেকে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের কথা বলছেন। ওঁদের যুক্তি, ওই আইন মোতাবেক কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা ২৪ একরের বেশি জমি কিনতে পারে না। শিল্প গড়ার জন্য এর বেশি জমি দরকার পড়লে সরকারের কাছ ১৪ওয়াই ধারায় আবেদন করতে হয়। সরকার মনে করলে জমিটি আবেদনকারীকে ‘লিজ’ দেয়।

এবং এ হেন আইনি প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন উঠছে, রাজারামবাবু এত জমি কেনার চুক্তি করলেন কী ভাবে? “রাজারামবাবুর বক্তব্য সত্যি হলে তো বলতে হয়, প্রথমে উনি-ই আইন ভেঙেছেন!” মন্তব্য এক আইনজীবীর। রাজারামবাবুর অবশ্য দাবি, “জমি কেনার টাকা আমি একা দিইনি। কুড়িটি কোম্পানি মিলে দিয়েছি।” তারা কারা, সে প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর অবশ্য মেলেনি।

শুধু এই অসঙ্গতি নয়। আসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে আরও বড় সমস্যার মুখে পড়েছেন রাজারাম। তার জেরে এ দিন ওঁর তলব পড়েছিল ইডি অফিসে, যারা কি না সারদার টাকা লেনদেন নিয়েও তদন্ত করছে। রাজারাম শরাফের কাছে ইডি-র জিজ্ঞাস্য, রাজারহাটের জমি কেনা বাবদ যে কয়েক কোটি টাকা খরচের কথা তিনি অভিযোগে লিখেছেন, তা এল কোথা থেকে? ইডি-সূত্রের খবর, সারদা কেলেঙ্কারিতে আসিফেরও নাম জড়িয়েছে। ইডি তাঁকে ইতিমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এখন তারা খতিয়ে দেখছে, আসিফ-রাজারামের যোগাযোগ এবং এত টাকা লেনদেনের মধ্যে সারদার কোনও ছোঁয়া রয়েছে কি না।

পাশাপাশি রাজারামবাবুর বিপদ বাড়িয়েছেন রাজারহাটের জমির মালিকদের একাংশ। কী রকম?

রাজারাম অভিযোগে বলেছেন, বিতর্কিত যে ৪০ একর পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আসিফ তাঁর আট কোটি টাকা নিয়েছেন, বিভিন্ন ব্যক্তির মালিকানাধীন ওই জমির বেশ কয়েকটি দলিলের প্রতিলিপি আসিফ তাঁকে দিয়েছিলেন যাচাই করে দেখতে। তিনি তা যাচাই করে দেখেনও বলে রাজারামের দাবি। আর তা শুনেই প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট জমির মালিকেরা। ওঁদের বক্তব্য: ওই চল্লিশ একর নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে, যে কারণে রাজ্য সরকার তা অধিগ্রহণ করতে পারেনি। “মামলার কথা জেনে, কাগজপত্র দেখার পরেও রাজারাম আসিফকে কেন টাকা দিলেন, সেটা আমাদের মাথায় ঢুকছে না।” বলছেন ওঁরা। মালিকদের দাবি, জমি কেনা-বেচার ব্যাপারে রাজারামের সঙ্গে তাঁদের কোনও কথা তো হয়ইনি, এমনকী আসিফও কখনও তাঁদের বলেননি যে, রাজারাম জমি কিনতে চান।

অথচ রাজারামের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের রুজু করা মামলায় এমনই দুই জমি-মালিককে (প্রভাস ওরফে দিলীপ রায় এবং সুকুমার চট্টোপাধ্যায়) সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে ওঁরা স্বভাবতই বিব্রত, বিভ্রান্তও। ওঁদের জমি নিয়ে জটিলতা কী?

রাজারহাটের জমি সরকার অধিগ্রহণ করার অনেক আগে, ১৯৮৬ থেকে বেশ ক’দফায় ওখানে ১৪৪ বিঘে জমি কিনে রেখেছিলেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ৬৭৪ জন। কেউ কিনেছিলেন কাঠাপিছু তিন হাজার টাকায়, কেউ চার হাজারে। ‘হাতিয়াড়া প্রভাতী সমবায়’ (অনুমোদিত নয়) গড়ে ওঁরা রাস্তা, জল, বিদ্যুতের মতো পরিকাঠামো চেয়ে দরবার শুরু করেন রাজ্য সরকারের কাছে। কোনও লাভ হয়নি। ইতিমধ্যে নিউটাউন গড়ার জন্য রাজারহাটের জমি অধিগ্রহণ করতে ১৯৯৬-এ সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তার বিরুদ্ধে জমি-মালিকেরা হাইকোর্টে চলে যান। হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, ওই জমি সরকার যেমন অধিগ্রহণ করতে পারবে না, তেমন মালিকেরাও সেখানে বাড়ি বানাতে পারবেন না।

পরে একটা রফায় আসার লক্ষ্যে মালিকদের তরফে তদানীন্তন বাম সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। সুকুমারবাবুর কথায়, “আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাম আমলের শেষাশেষি তৎকালীন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে আলোচনায় কিছুটা কাজ এগিয়েছিল। এ বার চাইছিলাম তৃণমূলের কোনও বড় নেতা-নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।”

এমনই পরিস্থিতিতে স্থানীয় তৃণমূল নেতা করিবুল মারফত আসিফ খান এসে তাঁদের সাহায্যের প্রস্তাব দেন বলে সুকুমারবাবুর দাবি। দিলীপবাবু বলেন, “আমরা চাইছিলাম, সরকার আমাদের জমি অধিগ্রহণ করে নিক। বদলে এখানে বা রাজারহাটেরই অন্য কোথাও এক হাজার বর্গফুট জমি দিক।” দিলীপবাবু-সুকুমারবাবুরা জানিয়েছেন, আসিফ ওঁদের রাজারামের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু অভিযোগ, ওঁদের বলা হয়েছিল রাজারাম বড় শিল্পপতি, সরকারের উঁচু মহলে আনাগোনা। তাই তিনি সহজেই সুরাহা করে দিতে পারবেন। এক বারও বলা হয়নি যে, রাজারাম নিজেই জমি কিনতে আগ্রহী।

তা হলে রাজারামবাবু তো বিলক্ষণ জানতেন যে, জমি ঘিরে আইনি জটিলতা আছে! এমন জমি কেনার জন্য তিনি আসিফকে আট কোটি দিলেন কোন যুক্তিতে?

রাজারামের কাছে ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ ইতিমধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিন-তিন বার দিলীপবাবুদের ডেকে পাঠিয়েছে। বয়ান লিখিয়ে সই করিয়ে নিয়ে সেই বয়ানকে মামলার সঙ্গে জুড়ে তাঁদের অন্যতম সাক্ষী হিসেবেও দেখিয়ে দিয়েছে। এ দিন দিলীপবাবুরা দাবি করেন, সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে তাঁরা বিন্দুবিসর্গ জানেন না। পুলিশের তলব পেয়ে তাঁরা গিয়ে লিখিত বয়ান দিয়ে এসেছেন। বয়ানে তাঁরা জানিয়েছেন, রাজারাম তাঁদের থেকে কখনও জমি কিনতে চাননি। এমনকী, আসিফ খানও কখনও তাঁদের জমি বেচার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার পাকা আশ্বাস দেননি।

সব মিলিয়ে রাজারামবাবুর যে অভিযোগের ভিত্তিতে আসিফকে গ্রেফতার করল পুলিশ, তার গোড়াতেই বিস্তর গলদ খুঁজে পাচ্ছেন আইনজীবীদের একাংশ। পুলিশের কী বক্তব্য?

বিধাননগরের গোয়েন্দা-প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুইয়ের জবাব, “জমি সংক্রান্ত দফতরই বলতে পারবে, জমির ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘিত হয়েছে কি না। রাজারামের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা আসিফের নামে প্রতারণার মামলা করেছি। অভিযোগ, ওই জমিতে মামলা-মোকদ্দমার জট কাটিয়ে দেবে বলে আসিফ আট কোটি টাকা নিয়েছিল। তারই তদন্ত চলছে।”

এ দিন বিকেলে সল্টলেকে ইডি অফিসে হাজিরা দেওয়ার আগে রাজারাম শরাফ বিধাননগর কমিশনারেটেও গিয়েছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE