Advertisement
E-Paper

মাওবাদী ঠেকাতে রাস্তা, তোলা তুলছে তারাই

প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে প্রধান সড়ক ও নিকটবর্তী গঞ্জের সঙ্গে জুড়তে জঙ্গলমহলে শুরু হয়েছে রাস্তা নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। সড়ক তৈরির সাড়ম্বর উৎসব যেন! সবই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায়। লাল মোরাম মাটি ঢাকা পড়ছে কালো বিটুমেনে। প্রশাসন মনে করছে, রাস্তা তৈরি করলে ঠেকিয়ে রাখা‌ যাবে মাওবাদীদের। বন্ধ করা যাবে তাদের পুনরুত্থানের পথ।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫

প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে প্রধান সড়ক ও নিকটবর্তী গঞ্জের সঙ্গে জুড়তে জঙ্গলমহলে শুরু হয়েছে রাস্তা নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। সড়ক তৈরির সাড়ম্বর উৎসব যেন! সবই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায়। লাল মোরাম মাটি ঢাকা পড়ছে কালো বিটুমেনে। প্রশাসন মনে করছে, রাস্তা তৈরি করলে ঠেকিয়ে রাখা‌ যাবে মাওবাদীদের। বন্ধ করা যাবে তাদের পুনরুত্থানের পথ।

কিন্তু হচ্ছে আর এক রকম। পুলিশ ও শাসক দলের একাংশের অভিমত— এই রাস্তাই এখন মাওবাদীদের টাকার জোগানদার হয়ে উঠেছে। তাঁদের দাবি, লালগড় ও আশপাশে রাস্তার কাজের বরাত পাওয়া অন্তত তিন জন ঠিকাদারের কাছ থেকে ইতিমধ্যে মোটা টাকা আদায় করেছে মাওবাদীরা। সহজবোধ্য কারণেই থানায় অভিযোগ দায়ের করেনি কোনও ঠিকাদার।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘মাওবাদীরা কয়েক জন ঠিকাদারের কাছ থেকে তোলা নিয়েছে, সেটা আমাদের কানে এসেছে। তবে অভিযোগ না পেলে আমাদের পক্ষে পদক্ষেপ করা মুশকিল।’’

শাসক দল তৃণমূলের রামগড়ের অঞ্চল সভাপতি সাগুন হেমব্রম বলেন, ‘‘সম্প্রতি তিন জন মাওবাদী বাঁকুড়া থেকে এসে এখানকার কুসমাশুলি গ্রামে রাত কাটিয়ে যায়। ওরা চলে যাওয়ার দু’দিন পরে সেটা জানতে পারি। তারাই ঠিকাদারের কাছ থেকে তোলা আদায় করে নিয়ে গিয়েছে।’’ রামগড়ে শালুকা থেকে মহুলতলা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রাস্তাটি তৈরির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের বাড়ি বাঁকুড়ায়। তা হলে রামগ়ড়ে মাওবাদীরা উজিয়ে এল কেন? সাগুন জানান— মাওবাদীরা জানতো, ঠিকাদারের ম্যানেজার থাকেন কুসমাশুলির পাশের গ্রাম শালুকায়। তাঁর কাছেই রাখা থাকে ঠিকাদারের নগদ টাকা। সাগুনের কথায়, ‘‘অঙ্কটা বলতে পারব না, তবে ওরা বেশ মোটা টাকাই নিয়ে গিয়েছে।’’

শালুকা থেকে মহুলতলা, বছর চার-পাঁচ আগেও ছিল মাওবাদীদের করিডর। এক দিকে কলাইমুড়ি-বীরভানপুর, অন্য দিকে বেলবনি-বাঁকিশোলের মতো মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি। এই সব মাথায় রেখেই তৈরি হচ্ছে ওই রাস্তা। কিন্তু সেই রাস্তা থেকেই ফায়দা তুলে নিয়ে যাচ্ছে মাওবাদীরা— এমনটাই দাবি পুলিশ ও শাসক দলের।

অথচ মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা কিংবা একদা মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, এমন সব তল্লাটে পাকা রাস্তা করলে দ্বিমুখী সুবিধে। এক, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো পরিষেবা ও সুযোগ-সুবিধে নিয়ে সরকার হাজির হতে পারবে ওই সব গ্রামে। এতে মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রশমিত হবে। দুই, গণ্ডগোলের খবর পাওয়ার পর পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী দ্রুত পৌঁছে যেতে পারবে প্রত্যন্ত এলাকায়। কেন না, পিচরাস্তায় মাইন পুঁতে ফাটানোর কৌশল মাওবাদীরা রপ্ত করলেও, সেই পথ তারা সচরাচর এড়িয়েই চলে।

ছত্তীসগঢ়ের বস্তার জেলার পুলিশ সুপার অজয়কুমার যাদব যেমন সম্প্রতি বলেছেন, ওই জেলার যেখানে যেখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে, সেখানেই নকশালদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। সেটা বুঝেই বস্তার, দন্তেওয়াড়ার বিস্তীর্ণ অংশে মাওবাদীরা এখন পাকা রাস্তা তৈরির কাজে বাধা দিচ্ছে। তবে ঝাড়গ্রামের এক সিপিএম নেতা বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের এখন আর সেই শক্তি নেই। কাজেই রাস্তা তৈরিতে ওরা বাধা দিতে পারবে না। তবে ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা ওদের ভয় পান। তাই, মাওবাদীরা তাঁদের কারও কারও কাছ থেকে তোলা আদায় করেই সন্তুষ্ট।’’

জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, দু’বছর ধরে শুধু লালগড়েই অন্তত ৭০ কোটি টাকার রাস্তার কাজ চলছে। এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘এই সরকারি টাকার একটা অংশ ভয় দেখিয়েই যদি পকেটে ঢোকে, তা হলে মাওবাদীরা খামোখা গণ্ডগোল করতে যাবে কেন!’’

তৃণমূলের এক নেতা জানান, জামবনিতে ঝা়ড়খণ্ড সীমানার কাছে নির্মীয়মাণ একটি রাস্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারের কাছ থেকে সম্প্রতি মোটা টাকা আদায় করেছে মাওবাদীরা। ওই নেতার কথায়, ‘‘মাওবাদীরা ওই ঠিকাদারকে বলেছে, গাড়ি পোড়াব না, মারধরও করব না। শুধু নগদ চাই আমাদের। ঠিকাদার টাকা দিতে কালক্ষেপ করেননি।’’

তবে লালগড়ে রাস্তার কাজ করা এক ঠিকাদারের আত্মীয়কে মাওবাদীরা কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখেছিল বলে জানাচ্ছেন এলাকার মানুষ। তাঁদের দাবি, ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাওবাদীরা জানায়, দশটি মোটর সাইকেল কেনার টাকা দিতে হবে, না হলে ভাইপোকে ছাড়া হবে না। ঠিকাদার যে রাস্তা করছেন, সেটি লালগড়-ধেরুয়া পিচরাস্তার সঙ্গে ভুলাগাড়া গ্রামকে জুড়ে দেবে। সেই ভুলাগাড়া, যেখানে ২০০৯-এর ২২ অক্টোবর সাংবাদিকদের ডেকে কিষেণজি মুক্তি দিয়েছিলেন সাঁকরাইলের অপহৃত ওসি তথা ‘যুদ্ধবন্দি’ অতীন দত্তকে। ভুলাগাড়া ছিল মাওবাদীদের খাস তালুক। বড়জোর বিশ ঘর লোকের বাস সেই প্রত্যন্ত ভুলাগাড়া গ্রামকে এখন চার-পাঁচ দিক থেকে জোড়া হচ্ছে পিচরাস্তা দিয়ে। তাতে অবশ্য তোলাবাজি বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই।

Jangalmahal Road Trinamool
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy