রাজা বড় ধনকাতুরে, টুনির ধন কেড়ে নিলে।
রাজ্য সরকারের দিকে এমনই অভিমান-ভরা সুরে কথা বলতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ গ্রামোন্নয়ন সমিতি সদস্যেরা। সমিতিগুলির সামান্য পুঁজি এ বার নিয়ে নিচ্ছে রাজ্য সরকার। পুজোর পরেই সমিতির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েত দফতর। সরকারের যুক্তি, গ্রামোন্নয়ন সমিতি তামাদি হয়ে গিয়েছে। টাকা ফেলে রাখার আর দরকার নেই।
গ্রামোন্নয়ন সমিতি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনও সরকারি নির্দেশিকা পাঠিয়ে জানানো হয়নি গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে। ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর স্রেফ চুপ করে থেকে, অর্থাৎ সমিতি গড়ার নির্দেশিকা না পাঠিয়ে সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল যে বাম আমলের এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তারা উৎসাহী নয়। পঞ্চায়েত স্তরে বিভ্রান্তি ছিল, সমিতি আদৌ গড়া হবে কিনা। কিন্তু ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ স্পষ্ট করে দিল, গ্রামোন্নয়ন সমিতির দিন শেষ।
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামোন্নয়ন সমিতির আর দরকার নেই। যে সব গ্রামোন্নয়ন সমিতির অ্যাকাউন্টে খরচ না-হওয়া টাকা পড়ে আছে সেগুলি বেআইনি। কারণ, ওইসব গ্রামোন্নয়ন সমিতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে সেই টাকা তুলে নেওয়া হবে। পুজোর পরেই এই কাজ শুরু হবে।” দফতর সূত্রে খবর, ওই টাকা গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে দিয়ে দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত আইনে অবশ্য গ্রামোন্নয়ন সমিতি গড়ার কথা আছে। সমিতি গঠন করার পক্ষে যুক্তি ছিল, গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে গ্রামবাসীদের সঙ্গে জনে জনে আলোচনা করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেই কারণে প্রতিটি সংসদ থেকে গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি নিয়ে একটি সমিতি থাকা দরকার। সমিতি এক দিকে যেমন গ্রামবাসীর হয়ে পঞ্চায়েতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, অন্য দিকে পঞ্চায়েতের কাজ গ্রামবাসীর মধ্যে প্রচার করবে। এই চিন্তা থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি সংসদে একটা করে সমিতি গড়া হয়। কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করার ক্ষমতা দেওয়া হয় সমিতিকে। গ্রামোন্নয়ন সংক্রান্ত পরিকল্পনা রচনা এবং গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তা রূপায়ণে ভার দেওয়া হয় সমিতিকে। এ ভাবে গ্রামবাসীদের যোগদানের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ বাস্তবায়িত হবে, এমন আশাও করেন অনেকে। মূলত জনস্বাস্থ্য খাতেই সরাসরি কেন্দ্রের থেকে টাকা পেত সমিতিগুলি। ছোটখাটো উন্নয়নমূলক কিছু কাজেও সমিতিগুলি টাকা পেত। তবে তা কোনওমতেই একবারে ২০ হাজারের বেশি ছিল না।
প্রথম দিকে গ্রাম সংসদের সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে সমিতি গড়া হত। ক্রমশ দেখা যায়, এলাকায় যে রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য, তারাই জোর করে সমিতি গড়ছে। ২০০৭ সাল থেকে নিয়ম হয়, মনোনয়নের মাধ্যমে সমিতি গড়া হবে। গ্রাম সংসদের নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যের পাশাপাশি সমিতিতে জায়গা দিতে হবে নিকটতম পরাজিত প্রার্থীকেও। সমাজের নানা অংশের প্রতিনিধিত্ব সমিতিতে রাখার নিয়ম হয়। সদস্য সংখ্যা ১৬ জনের মধ্যে রাখা হয়।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই অনেক জায়গায় সমিতির ডানা ছাঁটা শুরু হয়। গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যরা অভিযোগ করেন, সমান্তরাল প্রশাসন গড়ার চেষ্টা করছেন সমিতির সচিব। অভিযোগ আসে, পঞ্চায়েত কর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও দুর্নীতি রোধে সফল হয়েছে সমিতি। তাতেই ক্ষোভ নির্বাচিত সদস্যদের। আধিকারিকদের একাংশ আবার আপত্তি তোলেন, সরকারের তরফ থেকে সমিতিগুলিকে নিজস্ব কর্মী দেওয়া হয়নি। সমিতির কাজকর্মের তদারকি, হিসাব পরীক্ষার বাড়তি কাজ চাপছে পঞ্চায়েত আর জেলার কর্মীদের ওপর।
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। গোড়া থেকেই তৃণমূল সরকারের মত ছিল গ্রামোন্নয়ন সমিতি তুলে দেওয়ার পক্ষে। দফতরসূত্রে খবর, জেলা প্রশাসনের কর্তাদের অনেকে নাকি সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন সরকারকে। গ্রামোন্নয়ন সমিতি তৈরির নির্দেশ না দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দেয়, তাঁদের সায় নেই সমিতিতে। টাকা উদ্ধারের কাজ সহজ হবে না বলে অনুমান রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের আধিকারিকদের একাংশের। তাঁদের মত, যেহেতু গ্রামোন্নয়ন সমিতিগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে সই করে টাকা তুলবে কে? দ্বিতীয়ত কত টাকা খরচ হয়েছে, কতই পড়ে আছে তার হিসাব জরুরি। পড়ে থাকা টাকার পরিমাণও খুব বেশি নয়। “এই টাকা তুলতে ঢাকের দায়ে মনসা না বিকিয়ে যায়,” মন্তব্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক আধিকারিকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy