Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সবং কাণ্ডে পুলিশি ‘দ্বিচারিতা’ এ বার হাইকোর্টেও প্রশ্নের মুখে

বিরোধীরা এই প্রশ্ন আগেই তুলেছিলেন। বুধবার সবং-কাণ্ডে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সেই প্রশ্নই তুলল কলকাতা হাইকোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ২০:৫৭
Share: Save:

বিরোধীরা এই প্রশ্ন আগেই তুলেছিলেন। বুধবার সবং-কাণ্ডে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সেই প্রশ্নই তুলল কলকাতা হাইকোর্ট।

সবং কলেজে ছাত্র খুনের ঘটনার অন্যতম দুই অভিযুক্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-র কর্মী শেখ মুন্না ও সানোয়ার আলির জামিনের আবেদন খারিজ করে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী ও বিচারপতি শঙ্কর আচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ এদিন বলেছে, পুলিশের তদন্ত রিপোর্টই বলছে ওই দুই অভিযুক্ত সংঘর্ষে জড়িত ছিল। তারা বেআইনি ভাবে কলেজে অন্যদের সঙ্গে জড়ো হয়েছিল বলেও কেস ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ কেন তাঁদের বিরুদ্ধে লঘু ও জামিনযোগ্য ধারায় চার্জশিট পেশ করল তার ব্যাখ্যা পুলিশ দিতে পারেনি।

এদিন টিএমসিপি কর্মী শেখ মুন্না ও সানোয়ার আলি নামে ওই দুই অভিযুক্তের জামিন চেয়ে তাঁদের আইনজীবী হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। এদিন মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে পাবলিক প্রসিকিউটার মনজিৎ সিংহ আদালতকে জানান, পুলিশ তদন্ত শেষ করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে। এই দুই অভিযুক্ত ৮০ দিন জেল হেফাজতে রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে।

এর পরেই মামলার অন্য এক অভিযুক্ত তথা ওই কলেজের ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়ের আইনজীবী প্রীতম চৌধুরী ও জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতকে বলেন, তাঁদের মক্কেল সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় এফআইআর দায়ের করেছিলেন। অথচ পুলিশের তদন্তকারী অফিসার তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের মামলায় চার্জশিট পেশ করেছে। যে দুই অভিযুক্ত জামিনের আবেদন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করেনি পুলিশ।

এরপরেই বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী সরকারি কৌঁসুলির কাছ‌ে মামলার কেস ডায়েরি দেখতে চান। কেস ডায়েরি খুঁটিয়ে পড়ে বিচারপতি বাগচী সরকারি কৌঁসুলির উদ্দেশে বলেন, ‘‘পুলিশের রিপোর্ট বলছে অভিযুক্ত মুন্না ও সানোয়ার ঘটনার দিন বেআইনি ভাবে কলেজে জড়ো হয়েছিল। তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিল বলেও মামলার নথিতে বলা আছে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটে লঘু ধারা দেওয়া হল কেন?’’ বিচারপতি বাগচীর পরের প্রশ্ন, ‘‘এই দুই অভিযুক্তেরও তো একই উদ্দেশ্য ছিল। তা হলে জামিনযোগ্য ধারা দিল কেন তদন্তকারী অফিসার?’’

পাবলিক প্রসিকিউটার বলেন, কেস ডায়েরিতে যা রয়েছে, তার বাইরে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। বিচারপতি বাগচী এর পরে প্রশ্ন করেন, ‘‘এই দুই অভিযুক্ত জেল হেফাজতে রয়েছেন কেন?’’ সরকারি কৌঁসুলি বলেন, ‘‘খুনের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে। সেই কারণে নিম্ন আদালত হাইকোর্টের মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ দেয়নি। এর পরেই হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, জামিনযোগ্য ধারায় চার্জশিট পেশ হলেও তারা ওই দুই অভিযুক্তকে জামিন দেবে না।

সবং-কাণ্ডে পুলিশ যে একজনের দায় অন্যের উপরে চাপিয়েছে এদিন হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সেটাই পরিষ্কার করে দিল বলে সবং-য়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া মন্তব্য করেছেন। মানসবাবুর বক্তব্য, ‘‘সবং কাণ্ডে প্রথমে তিন জন টিএমসিপি কর্মীকে গ্রেফতার করার পরে তদন্তকারী অফিসারকে সরানো হয়। তারপরই জেলা পুলিশ সুপার তদন্তের নামে খেলা শুরু করেন। পরিণামে নিরপরাধদেরই জামিন অযোগ্য ধারা দেওয়া হয়। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রয়েছে।’’ ধৃত ছাত্র পরিষদ কর্মীদের হয়ে নিম্ন আদালতে মামলা লড়ছেন হরিসাধন ভট্টাচার্য। এ দিন তিনি বলেন, “পুলিশের চার্জশিট থেকে স্পষ্ট, দোষীদের আড়াল করে নির্দোষদের জড়ানো হয়েছে।’’ হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশ প্রসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “সবং মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন। আমি মন্তব্য করব না।’’

সবং কাণ্ডে নিহত কৃষ্ণপ্রসাদের দাদা হরিপদ জানা বলেন, ‘‘প্রথম থেকেই পুলিশ তদন্তে গুরুত্ব দেয়নি। সেই কারণেই আমরা সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করেছি।’’ ধৃত ছাত্র পরিষদ কর্মী অনুপম আদকের মা প্রতিমার আশা তাঁর ছেলে এবার ন্যায় বিচার পাবে।

গত ৭ অগস্ট সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার অব্যবহিত পরে তিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) ও চার জন সিপি কর্মী গ্রেফতার হন। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইঙ্গিত দেন, ঘটনার পিছনে রয়েছে ছাত্র পরিষদের-র নিজস্ব কোন্দল। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ সাংবাদিক বৈঠক করে কার্যত সিলমোহর দেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘তত্ত্ব’-কে। তিনি দাবি করেন, কলেজের সিসিটিভি ফুটেজে ধৃতদের দেখা যায়নি। এক ধাপ এগিয়ে, নিহত কৃষ্ণপ্রসাদকেই কলেজে দাপিয়ে হুমকি দেওয়া দলের সদস্য বলতেও ছাড়েননি। পরে তিনি দাবি করেন, তদন্তে প্রায় স্পষ্ট যে ছাত্র পরিষদের অন্দরের অশান্তির জেরেই খুন হন কৃষ্ণপ্রসাদ।

ওই কলেজের ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায় পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করে জানান, কারা তাঁদের কলেজে ঢুকে চড়াও হয়। সেই সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা প্রকৃত দুষ্কৃতীদের আড়াল করে উল্টে ছাত্র পরিষদের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার করে। চার্জশিটে যে ২১জনের নাম রয়েছে, তারমধ্যে ১৯জন সিপি-র। ধৃত সিপি কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন অভিযোগকারী, সিপি পরিচালিত সবং কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়ও। ধৃত তিন জন টিএমসিপি কর্মীর মধ্যে শেখ মুন্না ও সানোয়ার আলির নাম চার্জশিটে থাকলেও তাঁদের নামে রয়েছে জামিনযোগ্য ধারা। চার্জশিটে ছিল না ধৃত অপর টিএমসিপি কর্মী অসীম মাইতির নামও। তার জেরে খুনের ঘটনার নিরপেক্ষ ও প্রকৃত তদন্তের দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর আদালতে মামলা দায়ের হয়। সেই মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sabang high court police college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE