কাঁটাতারে ভাঙা দুই দেশ জুড়ে গেল ছিটমহলবাসীর মিলন উৎসবে।
কারও চোখে জল। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কাঁটাতারও যেন আটকে রাখতে পাচ্ছে না তাঁদের। হাতে-হাত দিতে হুড়োহুড়ি চারদিকে। শুক্রবার কোচবিহারের তিনবিঘা সীমান্তে শহিদ দিবস যেন পরিণত হল ছিটমহলের বাসিন্দাদের মুক্তির দিবসে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির উদ্যোগে শহিদ দিবস পালন করা হয় তিনবিঘায়। দুই দেশের ১৬২ টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন সীমান্তে। তিনবিঘা করিডর দিয়ে মিছিলে সামিল হয় দুই পাশের মানুষ। পুলিশ-বিএসএফ জওয়ানরা মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় সেই ব্যারিকেডের মধ্যে দিয়ে হাত মেলাতে শুরু করেন দুই পাশের বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ ভূখন্ডের মধ্যে থাকা জলঢাকা ছিটমহল থেকে মিছিলে যোগ দেন লায়লি বেগম। ভারতের ভূখন্ডের মধ্যে থাকা নলগ্রাম সীমান্ত থেকে মিছিলে সামিল হন রূপসুনা খাতুন। কুড়ি বছর পর তাঁদের মধ্যে দেখা। করিডরের মধ্যে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। পুলিশ এসে সরিয়ে দেয় তাঁদের। রুপ্সুনা বলেন, “আমার মাসির সঙ্গে দেখা হল। সেই কুড়ি বছর আগে একদিন এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। আর দেখা হয়নি।” শুধু ওঁরা দুজনই নন, দুলাল হোসেন, রুপালি খাতুন, শহিদুল হক, প্রদীপ বর্মনরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁরা বলেন, “এতদিন পর মুক্তি পেলাম। খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি দিন কেটেছে আমাদের। জঙ্গলের প্রাণীদেরও গণনা হত কিন্তু আমরা কোনও দেশের গণনায় পড়তাম না।”
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির তরফে দাবি তোলা হয়, ২৬ জুনকে আন্তর্জাতিক শহিদ দিবস ঘোষণা করা হোক। কমিটির সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “অনেক আন্দোলনের অনেক শহিদের রক্তের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা পেল ছিটমহলের বাসিন্দারা। এই দিনেই ২ জন তিনবিঘায় আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের কথা মাথায় রেখেই আমরা এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক শহিদ দিবস ঘোষণার দাবি করেছি। এই দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলবে।” তাঁর ওই দাবিকে সমর্থন করেন বাংলাদেশের কমিটির নেতারাও। কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সম্পাদক গোলাম মোস্তাফা বলেন, “আমাদের একক আন্দোলনেই ফল পেয়েছি আমরা। এবারে ওই দাবিতেও আন্দোলনে সামিল হব।” পাশাপাশি পয়লা অগস্টকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হবে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যরাত থেকে ছিটমহলগুলিকে দুই দেশের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ১ অগস্ট বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।
তিনবিঘা করিডরে দু’দেশের আত্মীয়দের মিলনের আনন্দে চোখে জল।
১৯৯২ সালের ২৬ জুন তিনবিঘা করিডরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জীতেন রায় ও ক্ষীতেন অধিকারীর মৃত্যু হয়। এর পর থেকে ওই দিনটিকে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা । ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির পক্ষ থেকেও ওই দিনটিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রতি বছর তিনবিঘাতে তা নিয়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়। এবারে সেই দিনটি যে অন্যমাত্রা নেবে তা আগে থেকেই যেন ঠিক হয়েছিল। দুই পাশের ছিটমহলের মানুষের মধ্যে তা নিয়ে উন্মাদনাও ছিল প্রবল।
দুপুরে দুই পাশের মানুষ যখন সীমান্তে ভিড় জমাতে শুরু করেন তখন থেকেই আবেগের বাঁধ ভাঙে। তাঁদের চোখে জল। ভারতের মধ্যে থাকা ছিটমহলের বাসিন্দারা জড়ো হন শহিদ বেদির সামনে কাঁটাতারের এপারে। কাঁটাতারের ওপাশে জড়ো হন বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলের বাসিন্দারা। শুরু হয় বক্তৃতা। বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত, গোলাম মস্তাফারা। তাঁরা বলেন, “৬ জুন বাংলাদেশে দুই দেশের মধ্যে স্থল চুক্তি বিল স্বাক্ষর হয়। সেদিন থেকেই ছিটমহল বিনিময় ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা খুশি।” পূর্বতন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান ঊপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, “ সরকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে। ছিটমহলের বাসিন্দারা অনেক কষ্টের মধ্যে ছিলাম। আমরা সবসময় চেষ্টা করব যাতে তাঁরা এবারে ভাল থাকেন।” এ দিন কুচলিবাড়ি সংগ্রাম কমিটি, ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সংগ্রাম কমিটির তরফেও শহিদ দিবস পালন করা হয়।
ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy