Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হুমকি, মারধরেও বুথ ছাড়েননি সনৎ

বুকের কাছে জড়সড় দু’হাতের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে সাদা ইভিএম। মরিয়া হয়ে সেই ইভিএম আঁকড়ে বুথের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন তিনি। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক যুবক ক্রমাগত শাসিয়ে চলেছে তাঁকে, ‘‘মেশিনটা ছাড়বি নাকি আমি এ বার হাতের মেশিনটা চালাব, বল?’’ বুথের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানো শাসক দলের জনা দশেক দাপুটে কর্মীর এক জন কাউন্ট ডাউন শুরু করে, ‘‘এক...দুই....।’’

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই মধ্যমগ্রামে ধর্মঘট সমর্থনের মিছিলে সনৎ বিশ্বাস। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই মধ্যমগ্রামে ধর্মঘট সমর্থনের মিছিলে সনৎ বিশ্বাস। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

অরুণাক্ষ ভট্টচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

বুকের কাছে জড়সড় দু’হাতের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে সাদা ইভিএম। মরিয়া হয়ে সেই ইভিএম আঁকড়ে বুথের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন তিনি।

মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক যুবক ক্রমাগত শাসিয়ে চলেছে তাঁকে, ‘‘মেশিনটা ছাড়বি নাকি আমি এ বার হাতের মেশিনটা চালাব, বল?’’

বুথের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানো শাসক দলের জনা দশেক দাপুটে কর্মীর এক জন কাউন্ট ডাউন শুরু করে, ‘‘এক...দুই....।’’

ফর্দাফাঁই সাদা জামা রক্তে লাল, ইভিএম আঁকড়ানো অবস্থাতেই উত্তর আসে, ‘‘মেশিন লুঠ করতে হলে আমাকে খুন করতে হবে।’’

শনিবার, পুর-নির্বাচনের দুপুরে, মধ্যমগ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনার পরিণতি—ভোট-ডাকাতি রুখে ওই ওয়ার্ডে তৃণমূলের দাপুটে নেতাকে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়ে বাম-প্রার্থী সনৎ বিশ্বাসের জয়।

রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনের মুখে সূযর্কান্ত মিশ্র দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে ডাক দিয়েছিলেন—রাস্তায় নেমে ভোট-লুঠ প্রতিরোধ করুন, সকাল থেকে বুথ আঁকড়ে পড়ে থাকুন সকলে।

শনিবার দুপুরে পিস্তলের মুখে সনৎবাবু যে আক্ষরিকই সে পথে হাঁটবেন, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি দলের রাজ্য সম্পাদকও। তাই ভোট শেষে মধ্যমগ্রাম পুরসভার ওই আহত প্রার্থীকে আরজিকর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন সূযর্বাবু। সনৎবাবুকে বলেন, ‘‘আপনি যে ভাবে লড়াই করেছেন তা সত্যিই দলকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।’’

সনৎবাবু অবশ্য একা নন। দলের নির্দেশ মেনে, শনিবার এ ভাবেই উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন বুথে দিনভর পড়ে থেকে রিগিং রুখেছেন বামেদের আরও কয়েক জন প্রার্থী।

সিপিএমের অভিযোগ, কোথাও ইভিএম কোথাও বা চোখ রাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে বুথ থেকে হটিয়ে দেওয়া প্রতিরোধ করতে গিয়ে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের ‘শাসনে’ তাঁদের কারও মুখ ফেটেছে। কারও ভেঙেছে হাত।

বারাসত পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের এজেন্ট দিলীপ সাহাকে মারধর করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তাঁর চশমা। জামা ছিঁড়ে হেনস্থা করা হয় প্রার্থী সুশীল সরকারকেও। তবে, সনৎবাবুর পথ ধরেই তাঁরা কেউই ওই দিন বুথ ছেড়ে নড়েননি। মঙ্গলবার তার ফলও পেয়েছেন সুশীলবাবু। ওই ওয়ার্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইযের পরে জয়ী হয়েছেন তিনি।

ওই পুরসভারই ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটের বেশ কিছু দিন আগে থেকেই নাগাড়ে হুমকির মুখে পড়ছিলেন বাম প্রার্থী। বামেদের অভিযোগের তির এ ক্ষেত্রেও, তৃণমূলের বহিরাগতদের দিকে। তবে ভোটের দিন এক বারের জন্যও বুথের বাইরে পা দেননি ফরওয়ার্ড ব্লকের ওই প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘দাঁত কামড়ে সব অত্যাচার সহ্য করে গিয়েছি।’’ দলের মহিলা কর্মীদের নিয়ে বহিরাগতদের বুথ দখলও রুখে দিয়েছিলেন। ফল, ছশোরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি।

বামেদের পথেই বুথ কামড়ে পড়ে থেকে সাফল্য পেয়েছে কংগ্রেসও। তাদের দাবি, বারাসতের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের ‘প্রহারের’ মুখেও বুথ আঁকড়ে থেকে জয় পেয়েছেন দীপক দাশগুপ্ত।

নিউ ব্যারাকপুর পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে একই ভাবে তৃণমূলের ‘শত হেনস্থা’ সত্ত্বেও জয়ী হয়েছেন কংগ্রেসের পূণির্মা রায়। তিনি বলছেন, ‘‘জানতাম বুথ ছেড়ে নড়লেই তৃণমূল এসে ইভিএম ছিনতাই করে নিয়ে যাবে। তাই জল তেষ্টা পেলেও বুথ ছেড়ে যাইনি।’’

তবে, সনৎবাবুর হাড় হিম করা অভিজ্ঞতার ছোঁয়া ওঁরা পাননি। সনৎবাবু বলছেন, ‘‘মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ধরা অবস্থায় শাসক দলের ওই যুবকেরা এতটাই উত্তেজিত ছিল যে কোনও সময়ে তাঁদের পিস্তল ছুটে যেতে পারত।’’

মধ্যমগ্রাম পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন জোড়া খুনে অভিযুক্ত বিনোদ সিংহ ওরফে রিঙ্কু। সিপিএমের দাবি, ওই ওয়ার্ডটি পেতে এতটাই মরিয়া ছিল শাসক দল যে, তার জন্য বিরোধী প্রার্থীকে খুন করতেও পিছপা হত না তারা।

সনৎবাবু জানান, সারা দিন বুথের সামনে বসে থাকলেও বেলা আড়াইটা নাগাদ নিজের ভোটটি দিতে বুথে ঢোকেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘আমি ঢুকতেই হই হই করে জনা দশেক ছেলে ঢুকে পড়ল বুথে। তারপর ধমক দিয়ে সেক্টর অফিসারকে বুথ থেকে বের করে দিল।’’ তিনি জানান, এর পরেই পিস্তল উঁচিয়ে লুঠ শুরু করতে যায় তারা। সনৎবাবুর কথায়,
‘‘আমি বাধা দিতেই পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে আমাকে ফেলে দেয় ওরা। বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এক জন। রক্তাক্ত অবস্থাতেই আমি ছুট্টে গিয়ে ইভিএম আঁকড়ে ধরি।
বলি, ছাপ্পা দিতে গেলে আমাকে খুন করতে হবে।’’

প্রায় মিনিট চল্লিশের সেই লড়াই শেষে বাইরে পুলিশের জিপ আসতেই ইভিএম-এর আশা ছেড়ে সরে পড়ে ওই যুবকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE