দেখাই মেলে না বোরোলির। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব
ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে মাছের দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক পর্যটক। যা খুঁজছেন, কিছুতেই পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আগের বার ছোট ছোট রুপোলি মাছ নিয়ে যিনি বসেছিলেন, তিনি আর আসেন না?
দোকানি এক ঝলকেই বুঝে ফেললেন। হেসে বললেন, ‘‘ওই মাছ তো কালেভদ্রে ওঠে মশাই। আগের বার পেয়েছিল, তাই এসেছিল। আবার কবে পাবে জানি না।’’
পর্যটক বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘এ যেন টাইগার হিলে গিয়েও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পাওয়ার মতো হল।’’ ডুয়ার্সে যারা বেড়াতে যান, তাঁদের কাছে রুপোলি বোরোলি মাছের আকর্ষণ এতটাই।
কাঞ্চনজঙ্ঘা, নিবিড় অরণ্য, তিস্তার সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে উত্তরবঙ্গের নদীর রুপোলি শস্য বোরোলি। উত্তরবঙ্গে তার নাম তিস্তার ইলিশ। খুব বড় হলে সাড়ে তিন-চার ইঞ্চির এই চকচকে বোরোলি অবশ্য কেবল তিস্তা নয়— তোর্সা, করলা, রায়ডাক, বালাসন, কালজানিতেও মেলে। তিস্তার বোরোলি তার মধ্যে অভিজাত। তোর্সার বোরোলিও স্বাদে-গন্ধে দুর্দান্ত। কিন্তু এখন সব নদীতেই বোরোলির আকাল। কদা়চিৎ উঠলে সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যায়। আগে ছিল চারশো টাকা কেজি। এখন ছ’শোর নীচে নামে না।
শুধু আমজনতা নয়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বোরোলির ভক্ত। প্রণববাবুকে এই মাছ রান্না করে খাইয়েছেন রাষ্ট্রপতি ভবনের পাচক। তৃপ্তি করে খেয়েছেন কীর্ণাহারের ব্রাহ্মণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মাছের গুণগ্রাহী। রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি প্রণববাবু যখন দার্জিলিং সফরে গিয়েছিলেন তখন মমতাও সেখানে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘‘জানেন তো, তিস্তার বোরোলি খুব স্বাদু। আপনাকে একদিন রান্না করে খাওয়াব।’’
প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছুটি কাটাতে হলং, আলিপুরদুয়ার, সুকনা, গরুমারায় গেলে তাঁর পাতে কালো জিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বোরোলির পাতলা ঝোল দিতেই হতো। জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে রান্না করতেন কবির হোসেন। তাঁর কথায়, ‘‘চিতল পেটির কালিয়া দিলে ভেঙে অল্প একটু মুখে দিতেন। আর বোরোলি পেলে কথা বন্ধ করে সবটাই খেয়ে নিতেন।’’ কবিরের হাতের বোরোলি ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের। কবির বলেন, ‘‘প্রত্যেক বার খাওয়ার পরে ধন্যবাদ দিতেন। সেটা কতটা আমার প্রাপ্য আর কতটা বোরোলির, তা জানি না।’’ সর্ষে দিয়ে বোরোলির পাতুরি কিংবা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সবজে রঙের ঝোলও বিখ্যাত। এমনকী, বহুকালের কট্টর নিরামিষাশী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, ‘‘উত্তরবঙ্গ বলতেই বোরোলির কথা মনে পড়ে।’’
কিন্তু স্বাদের স্মৃতিটুকুই কেবল আছে। বোরোলি পাওয়া আজকাল দুষ্কর। এমনিতে বোরোলি মেলার কথা বর্ষার ঠিক আগে এপ্রিল-মে নাগাদ অথবা বর্ষার পরে অক্টোবর-নভেম্বরে। যখন নদীর জল কমে আসে। দশ বছর আগেও এই দুই সময়ে মোটামুটি ভাবে বাজারে বোরোলি ভালই উঠত। কিন্তু উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সুদীপ বরাট বলেন, ‘‘এখন বোরোলির পরিমাণ তার চেয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।’’
কেন? ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্তে’র লেখক দেবেশ রায় বললেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি নদীর অববাহিকার বাসিন্দারাই আগে এই মাছ খেতেন। এখন বোরোলির চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছে যে, জোগানে কুলোচ্ছে না।’’ কিন্তু মৎস্যজীবীদের বক্তব্য, দূষণের চোটেই বোরোলি কমছে। নদীর টলটলে পরিষ্কার প্রবহমান জল ছাড়া বোরোলি বাঁচে না। জলপাইগুড়ি সায়েন্স অ্যান্ড নেচার ক্লাবের সম্পাদক রাজা রাউত জানান, চা বাগানগুলোতে কীটনাশক ব্যবহার বেড়েছে। তা মিশছে নদীর জলে। তাই নদীর দূষণও বাড়ছে।
জলপাইগুড়িতে তিস্তা পাড়ের মৎস্যজীবী বিমল হালদারের কথায়, ‘‘বোরোলি খুব সুখী মাছ। জল একটু নোংরা হল তো আর দেখা পাওয়া যাবে না। থাকতে হবে স্রোতও।’’ সুদীপবাবুও জানান, ‘‘বোরোলির অক্সিজেন বেশি লাগে। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর জলে সেই অক্সিজেন পায় ওরা। তাই কেবল ওই ধরনের নদীতেই বোরোলি মেলে।’’ তাঁর বক্তব্য, তিস্তায় ব্যারাজ হওয়ার ফলে স্রোত কমেছে। বোরোলিও কমেছে। কিন্তু তোর্সায় কোনও ব্যারাজ নেই, তাই এখন তুলনামূলক ভাবে বোরোলি সেখানেই বেশি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে প্রাণিবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, ইলিশের মতোই বোরোলিরও স্বভাব হল ঝাঁক বেঁধে স্রোতের বিরুদ্ধে গা ভাসিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া। তা ব্যাহত হলেও বোরোলি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তা ছাড়া, পাহাড়ি এলাকায় ডিনামাইট ফাটিয়ে মাছ ধরার প্রবণতাতেও বোরোলি কমছে।
তাই বোরোলি বলে এখন অনেক সময়েই পাতে যা ফেলা হয়, তা নেপাল সীমান্ত লাগোয়া উত্তর বিহার থেকে আসা চালানি বোরোলি। স্থানীয় বাজারের কক্সা, কানঝাঁপি, জয়াও দিব্যি বোরোলি বলে চালানো হয়। দেখতে বোরোলির মতো হলেও, স্বাদে তার ধারেকাছে নয় সে সব।
সে কারণেই এ বার শুরু হয়েছে, বোরোলি বাঁচানোর উদ্যোগ। কোচবিহারের বিভিন্ন জায়গায় ১৪টি পুকুরে পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ করা হচ্ছে। কোচবিহার মৎস্য দফতরের সহ অধিকর্তা অলক প্রহরাজ জানান, পুকুরের জলে স্রোত না থাকলেও নানা ভাবে চেষ্টা হচ্ছে বোরোলিকে বাঁচিয়ে রাখার। তিনি বলেন, ‘‘যদি সফল হই, তা হলে ভাতের পাতে বোরোলির অভাব বরাবরের মতো ঘুচবে।’’
সহ প্রতিবেদন: নমিতেশ ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy