Advertisement
০৬ মে ২০২৪

এক ‘শট’-এ বদলে গেল গল্পটা, টাকার বান্ডিল ভর্তি ব্যাগ ফেরাল পড়ুয়ারা

সহদেব দাস আর মহাদেব মাঝি থাকে বর্ধমানের কেতুগ্রামের কান্দরা গ্রামে। পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। এক সঙ্গে স্কুলে যায়।

ফাজিলা বিবির সঙ্গে সহদেব দাস ও মহাদেব মাঝি। — নিজস্ব চিত্র

ফাজিলা বিবির সঙ্গে সহদেব দাস ও মহাদেব মাঝি। — নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৬ ০৪:০৬
Share: Save:

সহদেব দাস আর মহাদেব মাঝি থাকে বর্ধমানের কেতুগ্রামের কান্দরা গ্রামে। পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। এক সঙ্গে স্কুলে যায়। বছর বারোর ছেলে দু’টোর অভ্যাস— স্কুলের পথে রাস্তায় পড়ে থাকা স্টোনচিপ, ইট-পাথরের টুকরোয় ‘শট’ নিতে নিতে যাওয়া। কার লাথিতে পাথর কদ্দূর গেল, তাতেই নিষ্পত্তি জেতা-হারার। কে রোনাল্ডো, কে মেসি!

বৃহস্পতিবারও গ্রামের রাস্তা ধরে স্কুলে যাচ্ছিল দুই বন্ধু। চৌরাস্তার মোড়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে খয়েরি রঙের ছোট একটা ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে অভ্যাসের বসে মেরেছিল লাথি। ব্যাগটা বিশেষ নড়েনি।

ভারী কেন, কী আছে ব্যাগে? ঝুঁকি নিয়ে সেটা খুলে দুই মূর্তি দেখে, ভিতরে একশো আর পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল। সে ব্যাগ তুলে নিয়ে স্কুলে গিয়ে বন্ধু-শিক্ষকদের সাহায্যে তার মালিককে খুঁজে সেই টাকা (আট হাজার) ফিরিয়ে দিয়েছে দিনমজুর পরিবারের এই দুই ডানপিটে।

ব্যাগটা কান্দরা-পূর্বপাড়ার বাসিন্দা ফজিলা বিবির। মহিলার বাড়িতে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। ছেলে গুজরাতের সুরাতে দর্জির কাজ করে। সংসার চালানো আর বোনের কলেজের ফি বাবদ সে যে টাকা পাঠিয়েছিল, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে ব্যাগে রেখেছিলেন প্রৌঢ়া। পরে জিনিস কিনতে টাকা বার করতে গিয়ে বেখেয়ালে ব্যাগ খোয়ান।

কান্দরা গ্রামেরই বড়াল পুকুরের ধারে পাশাপাশি ঝুপড়িতে থাকে দুই বন্ধু। দু’জনেরই বাবা দিনমজুর, মা একশো দিনের কাজে যুক্ত। ভাই-বোন মিলে সংসারে লোক কম নয়। টানাটানিও রয়েছে। টাকা দেখে নিতে ইচ্ছে হয়নি? দুই কিশোর এক সঙ্গে বলে ওঠে, ‘‘ও তো আমাদের টাকা নয়, নেব কেন?’’ চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে মহাদেবের বাবা সুখ মাঝির। বলেন, ‘‘অভাব যে কী তা বুঝেও ওই টাকা ফিরিয়ে আমাদের মাথা উঁচু করেছে ছেলে দু’টো।’’

সহদেব আর মহাদেব জানাচ্ছে, ব্যাগে টাকা দেখে প্রথমে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল তাদের। চেপে বসেছিল ভাবনা— ব্যাগটা যেমন রয়েছে তেমনই পড়ে থাকবে, না সেটা তুলে নিয়ে তারা খোঁজ করবে মালিকের? মহাদেব বলে, ‘‘শেষে ভাবলাম, আমরা না নিলেও ব্যাগটা রাস্তায় পড়ে থাকলে অন্য কেউ টাকাটা নিয়ে নেবে। তাই ওটা স্কুলে নিয়ে যাই।’’

জ্ঞানদাস স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্র স্কুলে পৌঁছে শিক্ষক ও বন্ধুদের ঘটনাটা জানায়। শিক্ষকেরা এবং স্কুলের অন্য পড়ুয়ারাও নিজেদের মতো করে ব্যাগ-মালিকের খোঁজ শুরু করে। বাড়ি, পাড়া, এলাকা সূত্রে খোঁজখবরের চেষ্টা ফল দেয়। স্কুলছুটির সময়ে এক সহপাঠী সহদেবদের জানায়, গ্রামের পূর্বপাড়ায় ‘ফজিলাকাকি’ ব্যাগ হারিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে ওই মহিলার বাড়ি যায় দু’জন। তাঁকে নিয়ে আসে স্কুলে।

স্কুলের শিক্ষক, ওই গ্রামেরই বাসিন্দা শিবপ্রসন্ন পাল বলেন, ‘‘ফজিলা বিবির কাছ থেকে ব্যাগের রং, কত টাকা ছিল তাতে— সে সব খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েই ব্যাগটা ফেরত দেওয়া হয়। তবে সব কৃতিত্ব মহাদেব-সহদেবের।’’ হারানিধি ফেরত পাওয়া ফজিলার চোখে জল। বলেন, ‘‘ছোট ছেলে দু’টো যে ভাবে উপকার করল কোনও দিন ভুলব না! টাকাটা গেলে মেয়ের কলেজের ফি দিতে পারতাম না। সংসারেও টানাটানি হতো।’’ কেতুগ্রাম ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহের শেখ বলেন, “ছেলে দু’টোর জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আমরা ওদের সংবর্ধনা দেব।’’

ছেলে দু’টো তখন অন্য তর্কে ব্যস্ত। মহাদেব সহদেবকে বলছে, ‘‘তোর পায়ে জোর নেই। আমি শট মারলে ব্যাগটা যে কোথায় উড়ে যেত!’’ সহদেবের পাল্টা, ‘‘সব শট জোরে মারতে নেই রে। ব্যাগটা উড়ে গেলে কাকি কি টাকা ফেরত পেত?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

money School students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE