Advertisement
০৬ মে ২০২৪

মঞ্চে মাফিয়া বসিয়ে তোলাবাজি বন্ধের ডাক

মাইকে জোরালো গলায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতা বলছেন, ‘‘যাঁকে-তাঁকে নেতা করা চলবে না। যিনি নীতি নিয়ে চলেন, যাঁর ভাবমূর্তি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা করতে হবে তাঁকেই।’’ ঠিক সেই সময় মঞ্চে বসে শ্রীনু নায়ডু, খড়্গপুরের রেল মাফিয়া বলেই যার পরিচিতি। পিছনে জ্বলজ্বল করছে বিবেকানন্দের ছবি।

আইএনটিটিইউসি-র নেতাদের সঙ্গেই ম়ঞ্চে শ্রীনু নায়ডু (চিহ্নিত)। মঙ্গলবার মেদিনীপুরে রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।

আইএনটিটিইউসি-র নেতাদের সঙ্গেই ম়ঞ্চে শ্রীনু নায়ডু (চিহ্নিত)। মঙ্গলবার মেদিনীপুরে রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

মাইকে জোরালো গলায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতা বলছেন, ‘‘যাঁকে-তাঁকে নেতা করা চলবে না। যিনি নীতি নিয়ে চলেন, যাঁর ভাবমূর্তি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা করতে হবে তাঁকেই।’’ ঠিক সেই সময় মঞ্চে বসে শ্রীনু নায়ডু, খড়্গপুরের রেল মাফিয়া বলেই যার পরিচিতি। পিছনে জ্বলজ্বল করছে বিবেকানন্দের ছবি।

মঙ্গলবার এই দৃশ্যের সাক্ষী রইল শহর মেদিনীপুর। বিবেকানন্দের জন্মদিনেই মঙ্গলপাণ্ডে সরণীতে প্রকাশ্য সভার আয়োজন করেছিল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ মজুমদার, জেলা নেতা শশধর পলমল। সন্তোষবাবু যখন বলছেন, ‘‘ট্রেড ইউনিয়ন মানে তোলাবাজি নয়। এখন অনেকে সংগঠনে আসছেন, যাঁরা দু’-এক বছর সংগঠন করেই গলায় দু’টো সোনার চেন, একটি গাড়ি করে ফেলছেন’’, তখন পিছনে বসে শ্রীনু, গলায় মোটা সোনার চেন, কানে সোনার দুল আর ঠোঁটের কোণে হাসি।

এই শ্রীনুর বিরুদ্ধে ডাকাতি, তোলাবাজি, হুমকি-সহ অভিযোগের ইয়ত্তা নেই। জেলও খেটেছে সে। এমন লোককে অনুষ্ঠান মঞ্চে ডাকা কেন? আইএনটিটিইউসি-র জেলা নেতা শশধরবাবুর জবাব, ‘‘‘উনি কী ভাবে এলেন আমার জানা নেই। আমরা আমন্ত্রণ জানাইনি।’’

তবে তৃণমূল সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তৃণমূল লেবার সেলের চেয়ারম্যান তারক ভট্টাচার্যের সঙ্গেই এ দিন সভায় আসে শ্রীনু। এই সেলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারকবাবু অবশ্য শ্রীনুর মঞ্চে বসে থাকার মধ্যে আপত্তির কিছু দেখছেন না। তাঁর যুক্তি, ‘‘দস্যু রত্নাকর যদি বাল্মিকী হতে পারে তাহলে শ্রীনু নয় কেন?’’ তাঁর আরও সংযোজন, শ্রীনু তৃণমূল লেবার সেলের রাজ্য সম্পাদক। সংগঠনের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কার্যকরী সভাপতিও। ফলে, অনুষ্ঠানে তিনি আসতেই পারেন।

শ্রীনুর অতীত অবশ্য তৃণমূলের ভাবমূর্তির পক্ষে নেহাত সুখকর নয়। খড়্গপুরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ সেটলমেন্ট সংলগ্ন রেলবস্তির বাসিন্দা শ্রীনু খড়্গপুর রেল কারখানার কর্মী। ন’য়ের দশকে রেলের বিভিন্ন কাজে আধিপত্য ছিল মাফিয়া বাসব রামবাবুর ঠিকাদার সংস্থার। উদয় মাইতি, মানস চৌবে, গৌতম চৌবে-সহ একাধিক ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে রামবাবু ৭ বছর জেলবন্দি ছিলেন। তখনই তাঁর সাম্রাজ্যে ভাগ বসিয়ে উত্থান হয় শ্রীনুর। রেলের ওয়াগন শপ, আর ইয়ার্ড, ওয়ার্ক শপ, জেনারেল স্টোরে এখনও শ্রীনুর ঠিকাদারি সংস্থার একচেটিয়া রাজত্ব।

ক্রমে একাধিক অপরাধে নাম জড়ায় শ্রীনুর। ২০১০ সালে খড়্গপুরের এক শপিং মলে ডাকাতি, ২০১১ সালে রামবাবুর কনভয়ে হামলা, ২০১২ সালের ২৯ জুলাই রাধেশ্যাম গুপ্ত খুনের ঘটনায় অভিযোগ ওঠে শ্রীনুর বিরুদ্ধে। গত ২০ মার্চ খড়্গপুরের খরিদার কুমোরপাড়া এলাকায় স্থানীয় দুষ্কৃতীদের দুই গোষ্ঠীর গোলমাল বাধে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গত এপ্রিলে কলকাতা থেকে শ্রীনুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে জামিন পেয়ে যায়। কিছু দিন আগে সিপিএমের খড়্গপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনিতবরণ মণ্ডলকে মারধর ও হুমকির ঘটনাতেও নাম জড়ায় শ্রীনুর। এ বার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পায় সে।

বাম জমানায় বর্ধমানের খণ্ডঘোষে মঞ্চে উঠে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে ত্রাণ তহবিলের চেক তুলে দিতে দেখা গিয়েছিল আসানসোল শিল্পাঞ্চলের কয়লা-মাফিয়া বলে পরিচিত কালে সিংহকে। বিতর্কের মুখে বুদ্ধবাবু ওই চেক ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের অগস্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গাপুর সফরের সময়ে তাঁর পাশে দেখা গিয়েছিল বিতর্কিত কয়লা ব্যবসায়ী কৃষ্ণমুরারি কয়াল ওরফে বিল্লুকে। এক সময়ের রানিগঞ্জের বাসিন্দা বিল্লু সেখানকার এক মাফিয়ার সঙ্গী ছিলেন বলে দাবি করেছিলেন সিপিএম নেতারা। তিনি কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলেন, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।

তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে শ্রীনুর উপস্থিতি নিয়েও বিঁধতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের মতে, ‘‘এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি। এর মাধ্যমে কার্যত সমাজবিরোধীদের তোলাবাজির লাইসেন্স দেওয়া হল।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও প্রতিক্রিয়া, ‘‘খড়্গপুরে চিহ্নিত আতঙ্কসৃষ্টিকারী ব্যক্তিরা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের ছত্রছায়ায় বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভারতীই তো দুষ্কৃতীদের বরাভয় দিয়ে বলছেন, মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিও না। ফলে শাসক দলের সভায় শ্রীনুরা থাকবেন, এটা তো স্বাভাবিকই!’’ আর বিজেপির জেলা সভাপতি ধীমান কোলে বলেন, ‘‘এক তোলাবাজকে মঞ্চে বসিয়ে রেখে তোলাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ নিজেকেই অপমান করা।’’

শ্রীনুর সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা অবশ্য শুরু হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। গত পুরভোটের আগে একাধিকবার তৃণমূল নেতারা মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে শ্রীনুর সঙ্গে দেখা করতে যান। তা নিয়ে বিতর্কও হয় বিস্তর। বিজেপির টিকিটে পুরভোটে জিতেও শ্রীনুর স্ত্রী পূজা তৃণমূলে যোগ দেন। যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই শ্রীনু অবশ্য নির্বিকার। বলছেন, “আমার বিরুদ্ধে সব আসলে অপপ্রচার। এখন আমি ভালভাবে সংগঠনের কাজ করতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই।” শ্রীনুকে সমাজসেবী হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের লেবার সেলের নেতা তারকবাবুও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শ্রীনু না থাকলে কত মেয়ের বিয়ে হত না, কত ছেলেমেয়ে পড়তে পারত না। কেউ ভাল হতে চাইলে, সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে তাঁকে সুযোগ দেওয়াটাই দস্তুর।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news mafia tmc tmc with mafia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE