Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ছুটির হাওয়া

ছাত্রে দরদ? স্কুলের বরাতে শোকজ

পড়াশোনার কী হবে, সেটা পরের কথা। আসল হল, ‘সরকার’ চেয়েছেন। তাঁর মর্জির খেলাপ করে স্কুল খোলা রাখাটা বেআক্কেলে স্পর্ধা ছাড়া আর কী?

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০৩:৩৮
Share: Save:

পড়াশোনার কী হবে, সেটা পরের কথা। আসল হল, ‘সরকার’ চেয়েছেন। তাঁর মর্জির খেলাপ করে স্কুল খোলা রাখাটা বেআক্কেলে স্পর্ধা ছাড়া আর কী?

অতএব, হাতে-নাতে ফল পেয়ে গিয়েছেন রাজ্য সরকারপোষিত স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকা। যিনি কিনা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছুটি ঘোষণার সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও ক্লাস চালু রেখেছিলেন। বিকাশ ভবন তাঁকে পত্রপাঠ শোকজের চিঠি ধরিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের পাটও চুকেবুকে গিয়েছে। ‘প্রাক্‌-গ্রীষ্ম’ ও গ্রীষ্মাবকাশ মিলিয়ে টানা দু’মাসের ছুটিতে চলে গিয়েছে স্কুল।

কিন্তু সিলেবাস কী ভাবে শেষ হবে, সেটা কারওরই জানা নেই। ‘ফালতু’ ছুটির ধাক্কাটা আম-পড়ুয়া যে ভালই টের পাবে, সে ব্যাপারে শিক্ষক মহল মোটামুটি নিঃসংশয়। অনেকের আশঙ্কা, এ ভাবে পঠন-পাঠন শিকেয় উঠলে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতার ময়দানে টক্কর দেওয়াটাও পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের ছেলেমেয়েদের কাছে আরও অনেক বেশি কঠিন হবে। ‘‘এমনিতেই তো কর্মসংস্কৃতির দফারফা। এ বার ভাবী প্রজন্মকেও ছুটির হাওয়ায় ভাসিয়ে কেরিয়ারের বারোটা বাজানো হচ্ছে!’’— আক্ষেপ এক প্রবীণ শিক্ষাবিদের।

তাপপ্রবাহের কারণে রাজ্যের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপুষ্ট স্কুলে ১১ এপ্রিল থেকে ছুটি পড়ে গিয়েছে। টানা তাপপ্রবাহ বিদায় নিয়েছে, সেটাও প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল। অথচ ছুটিতে দাঁড়ি পড়েনি। এমতাবস্থায় বিকাশ ভবন নীরব থাকায় পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি স্কুল সিলেবাস শেষ করার জন্য ক্লাসের পঠনপাঠন শুরু করে দেয়। পরিণামে তাদের হাতে চলে এসেছে কারণ দর্শানোর ফরমান। পাঠিয়েছে রাজ্যের শিক্ষা দফতর।

স্বভাবতই এর পরে ক্লাস চালানোর প্রশ্ন নেই। শিক্ষকদের আক্ষেপেরও শেষ নেই। এক প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘গার্জেনদেরও প্রশ্ন ছিল, প্রাইভেট স্কুল যদি খোলা থাকতে পারে, তারা যদি পড়াশোনা চালাতে পারে, আমরা কেন বন্ধ রাখব? শোকজের নোটিস পেয়ে গার্জেনদের জানিয়েই ক্লাস বন্ধ করেছি।’’ কলকাতার পাঠভবন স্কুলও ১১ এপ্রিলের পরে ক’দিন চালু ছিল। ‘‘শো কজ নোটিস পেয়ে বন্ধ করতে হয়েছে।’’— বলেন প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায়। সান্ত্বনাদেবীর আক্ষেপ, ‘‘চেয়েছিলাম ঠিক সময়ে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করতে। কিন্তু সে আর পারলাম কই। ১৯ মে থেকে তো আবার গরমের ছুটি পড়ে যাচ্ছে।’’

লাগাতার ছুটির ধাক্কায় বিশেষত বারো ক্লাসের পড়ুয়ারা খাদের কিনারে। উচ্চ মাধ্যমিক সংসদের নিয়মানুযায়ী, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে একাদশের রেজাল্ট বার করা চাই। কিন্তু এ বছর বিধানসভা ভোটের দৌলতে বহু স্কুলে তা হয়নি। ঠিক সময়ে টুয়েলভের ক্লাসও শুরু করা যায়নি। এ দিকে সর্বভারতীয় ধাঁচে প্রজেক্টনির্ভর সিলেবাস হয়েছে। বারো ক্লাসের বিজ্ঞান-পড়ুয়াদের ল্যাবে প্রচুর সময় কাটাতে হয়, যে কাজ বাড়িতে বসে সম্ভব নয়।

এমতাবস্থায় টানা দু’মাস স্কুল না-হলে শোচনীয় পরিস্থিতির আশঙ্কা। ‘‘স্কুলের সিলেবাস ঠিক সময়ে শেষ না-হলে জয়েন্ট ও অন্যান্য সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া মুশকিল।’’— মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি দীপক দাসের। শাখাওয়াত গভর্নমেন্টের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সিংহমহাপাত্র বলেন, ‘‘কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য বোর্ডের পরীক্ষায় ঢিলে দেওয়া যায় না। সময় কমে যাওয়ায় অসুবিধে একটু হবেই।’’ পাশাপাশি তাঁর সংযোজন, ‘‘২০১৭ থেকে মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্রের ধরন বদলে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা নিয়ে পড়ুয়ারা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ভোগে। তার ওপর নতুন ধরনের প্রশ্নপত্রের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করাতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন। যা এ বার একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না।’’ হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষার সামন্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘বাড়তি ছুটির চাপটা সব চেয়ে বেশি পোয়াবে বারো ক্লাসই।’’

সরকার কী বলছে?

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, টানা ছুটিতে চাপের কিছু নেই। ‘‘ছুটি দিয়েছি মানে তো আর পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বলিনি!’’—বুধবার মন্তব্য করেছিলেন পার্থবাবু। এ কথাও বলেছিলেন, প্রাইভেট টিউশনের জমানায় স্কুলে পড়াশোনা না-হলেও তেমন সমস্যা হয় না। তাঁর বক্তব্য— স্কুল ছুটি থাকুক আর ক্লাস চলুক, ছাত্রছাত্রীরা সকলেই এখন গৃহশিক্ষকের উপরেই নির্ভরশীল। মাধ্যমিকের কৃতীদের অনেকেই জানিয়েছে, তাদের ১০ জন করে গৃহশিক্ষক রয়েছে। যা শুনে শিক্ষক মহল হতবাক। ‘‘কালের নিয়মে পাল্লা দিয়ে গৃহশিক্ষকের চাহিদা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু যেখানে দুপুরের খাবার না পেলে বাচ্চারা স্কুলছুট হয় বলে সরকারি রিপোর্টই বলছে, সেখানে গৃহশিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রীদের সকলের পড়ার সুযোগ পাওয়াটা মন্ত্রীর আকাশ-কুসুম কল্পনা’’— মন্তব্য এক শিক্ষাবিদের।

রাজনীতির চাপান-উতোরও জারি। মন্ত্রীর ছুটি ঘোষণাকে কটাক্ষ করে শুক্রবার বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর তোপ— ‘‘রাজ্যে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে।’’ পার্থবাবুর পাল্টা যুক্তি, ‘‘মন্ত্রী ছুটি ঘোষণা করেননি। শুধু অনুমোদন দিয়েছেন।’’

যদিও ঘটনা হল, গত ৯ এপ্রিল তৃণমূল ভবনে বসে পার্থবাবুই অনির্দিষ্ট কাল ছুটির ঘোষণা করেছিলেন। পরে স্কুলশিক্ষা দফতর তার নির্দেশিকা জারি করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bikash bhavan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE