Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশ পিটিয়ে, বন্দি ছিনিয়ে নিয়েও অধরা তৃণমূলের ‘জন’

দুই তৃণমূল কর্মীকে আটক করেছিল পুলিশ। তাদের রাখা হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) ফাঁড়িতে। অভিযোগ, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একদল তৃণমূল কর্মী সেখানে চড়াও হয়ে পুলিশকে মারধর করে ছিনিয়ে নিয়ে যান ওঁদের। আরও অভিযোগ, সামনে দাঁড়িয়ে গোটা ঘটনা ‘পরিচালনা করেন’ তৃণমূলের দার্জিলিং জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বিজন নন্দী ওরফে জন।

নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে ভাঙচুর হওয়া গাড়ি। তৃণমূল কার্যালয়ে অভিযুক্ত বিজন নন্দী (ডান দিকে)। ছবি:বিশ্বরূপ বসাক।

নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে ভাঙচুর হওয়া গাড়ি। তৃণমূল কার্যালয়ে অভিযুক্ত বিজন নন্দী (ডান দিকে)। ছবি:বিশ্বরূপ বসাক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

দুই তৃণমূল কর্মীকে আটক করেছিল পুলিশ। তাদের রাখা হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) ফাঁড়িতে। অভিযোগ, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একদল তৃণমূল কর্মী সেখানে চড়াও হয়ে পুলিশকে মারধর করে ছিনিয়ে নিয়ে যান ওঁদের। আরও অভিযোগ, সামনে দাঁড়িয়ে গোটা ঘটনা ‘পরিচালনা করেন’ তৃণমূলের দার্জিলিং জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বিজন নন্দী ওরফে জন।

মঙ্গলবার রাতে এনজেপি-তে এই পুলিশ পেটানোর ঘটনা অবশ্য অভূতপূর্ব কিছু নয়। এর আগে বীরভূমের বোলপুর, হুগলির চাঁপদানি, কলকাতার আলিপুর বা গিরিশ পার্ক— সর্বত্রই একই ঘটনা দেখা গিয়েছে। বোলপুরে পুলিশ পেটানোয় অভিযুক্ত সুদীপ্ত ঘোষ বহু টালবাহানার পরে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান। তিনি আবার এলাকায় অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। চাঁপদানির বিক্রম গুপ্ত এবং গিরিশ পার্কের গোপাল তিওয়ারিকে ধরতে বহু দিন লেগেছিল পুলিশের। গ্রেফতারের পরে তো গোপালের পরিবার অভিযোগ করেছিল, কাজ ফুরিয়েছে, তাই তার মাথার উপর থেকে হাত তুলে নিয়েছে তৃণমূল। আর আলিপুর কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত প্রতাপ রায়? বছর ঘুরতে চলতে চলল, সে এখনও আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শিলিগুড়ির বিজন নন্দী ওরফে জনের ক্ষেত্রে কি এর অন্যথা হবে? মঙ্গলবারের ঘটনার পরে জন সম্পর্কে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের মন্তব্য এই ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। গৌতমবাবু বলেছেন, ‘‘জন ভাল ছেলে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে!’’ এই কথা শোনার পরে অনেকেরই প্রশ্ন, এর পরেও কি বিজনকে ধরা সম্ভব পুলিশের?

এর ‘জবাব’-ও রয়েছে পুলিশের বুধবারের পদক্ষেপে। জনকে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, এ দিন রাত পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করেনি পুলিশ। সকালে শিলিগুড়ির এসিপি (পূর্ব) পিনাকী মজুমদার এমন কথাও বলেছিলেন যে, ‘‘পাড়ায় দু’পক্ষের গোলমাল হয়। কয়েক জনকে ধরা হয়েছে। থানা-ফাঁড়িতে কোনও ঘটনা ঘটেনি।’’ তবে পরে পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘একটা ঘটনা ঘটেছে শুনেছি। কী হয়েছে তা খোঁজ নিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।’’

ঘটনাচক্রে, জেলার কালিম্পং পাহাড়েই রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক’দিন আগে দলের কলেজে গোলমালের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দলের বিধায়ক দীপক হালদারকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন তিনি। এখন মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি জানার পরে কোনও পদক্ষেপের নির্দেশ দেন কি না, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে নানা জল্পনা রয়েছে।

সরকারি সূত্রে অবশ্য খবর, অভিযোগের সারবত্তা আছে কি না, তা পুলিশকে খতিয়ে দেখে যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। কারণ, আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের তরফে একাধিক অফিসার নানা মহলে ক্ষোভ জানিয়েছেন। বস্তুত পুলিশের একাংশের মধ্যে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, থানায় কাজ করতে গিয়ে যদি মাথা নিচু করে মার খেতে হয়, তবে আগামী দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে? পুলিশের একটি সূত্রের খবর, এই ক্ষোভের কথা মাথায় রেখে শাসক দলকে না চটিয়ে লঘু ধারায় মামলা করে দু’কূল বজায় রাখার পথ খুঁজছেন পুলিশ কর্তাদের কয়েক জন।

মঙ্গলবার রাতে ঠিক কী ঘটেছিল?

মন্ত্রী গৌতমবাবুর বিধানসভা এলাকার মধ্যেই এনজেপি এলাকায় ওই দিন বিকেলে তৃণমূল ও সিপিএমের দু’দল সমর্থকের মধ্যে গোলমাল হয় বলে পুলিশ সূত্রে খবর। সেই মতো উভয় পক্ষের ৪ জন থানায় হাজির হন। সিপিএমের ২ জন কাউন্সিলর তাপস চট্টোপাধ্যায় ও লোকাল কমিটির নেতা শম্ভু দে-ও থানায় যান। সিপিএমের দাবি, তার পরে রাতে আচমকা তৃণমূলের ৪০-৫০ জন মিলে ঢুকে হামলা চালায়। সিপিএম নেতা তাপসবাবু ও শম্ভুবাবুকেও পেটানো হয় বলে অভিযোগ। বাধা দিতে গিয়ে জখম হন পুলিশকর্মী জলেশ্বরবাবু ও রণজিৎবাবু। তখনই লক আপ থেকে ধৃত ২ তৃণমূল কর্মীকে বার করে নিয়ে যাওয়া হয়। বেরনোর সময় হামলাকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে বলেও অভিযোগ। রাতেই জলেশ্বরবাবুকে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়।

নার্সিংহোমে শুয়ে জলেশ্বরবাবু অভিযোগ করেন, জনবাবুর নেতৃত্বে হামলা হয়েছিল। তাঁর দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী, ‘‘ওরা হঠাৎ ফাঁড়িতে ঢুকে একজনকে মারধর শুরু করে। লোকটা মরে যাবে ভেবে এগিয়ে যাই। কাউন্সিলর-সহ আরও কয়েক জন লোক ছিল, তারাও মারধর শুরু করে। কাগজপত্র উল্টে, টেলিফোন, জলের জার ভেঙে দেওয়া হয়। প্রতিরোধ করতে গেলে আমাকেও মারা হয়। মুখে আঘাত লেগেছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘জন হচ্ছে মূল পান্ডা।’’

পুলিশের একাংশের দাবি, সিসিটিভি ফুটেজে জন নন্দীর ছবি স্পষ্ট না থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে, নাকি নাম ছাড়া মামলা হবে, তা ঠিক করা নিয়েই আলোচনা চলছে। যদিও আর একটি অংশের দাবি, প্রহৃত পুলিশ অফিসার জলেশ্বর রায়ের বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে। সেখানে তিনি নাম করে ফাঁড়িতে কী হয়েছে তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। সেই হিসেবে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এই ঘটনার পরে এ দিন সকাল থেকেই এনজেপি এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টা নাগাদ গেট বাজার এলাকায় পৌঁছে স্লোগান দিতে দিতে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য মিছিল নিয়ে ফাঁড়িতে যান। সেখানে ঢোকার মুখে গেটেই তিনি অনুগামীদের নিয়ে বসে থাকেন। থানায় ঢোকার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টা দেড়েক পর পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা অশোকবাবুকে টেলিফোন করে অনশন অবস্থান প্রত্যাহার করান। অশোকবাবু বলেন, ‘‘পুলিশ কমিশনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। তাই আমরা ২৪ ঘন্টা দেখব। না হলে কাল, শুক্রবার সকাল থেকে ফের এনজেপি ফাঁড়ি ঘেরাও অবস্থান শুরু হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE