সিঙ্গুর মামলার রায়ে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যেতে পারে।
সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ধন্দে পড়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে গোটা দেশের শিল্পমহল। তাঁদের আশঙ্কা, পুরনো জমি অধিগ্রহণ আইনে সব রাজ্যেই বেসরকারি শিল্পসংস্থা বা এসইজেড তৈরির জন্য জমি নেওয়া হয়েছে। কোথাও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কোথাও জমি এখনও ফাঁকা পড়ে। শিল্পমহলের আশঙ্কা, সিঙ্গুরের রায় দেখে ওই সব এলাকার কৃষকরাও এখন অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।
তার থেকেও বড় আশঙ্কা হল, সিঙ্গুরের মতো অনেক রাজ্যেই জনস্বার্থের নাম করে বেসরকারি শিল্পসংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে সেই সব মামলা ঝুলে রয়েছে। সেখানেও এ বার সুপ্রিম কোর্টের সিঙ্গুরের রায়কে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হবে। দাবি উঠবে, সিঙ্গুরের মতো ওই সব জমিও কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
শিল্পমহলের এই আশঙ্কা পৌঁছে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও। সরকারি সূত্রের খবর, প্রথম সারির বেশ কয়েকজন শিল্পপতি গত কালের রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এর ফলে কোথাও বিনিয়োগ করাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। পুরনো সরকারের অধিগ্রহণ করা জমির দায় যদি বর্তমান সরকার না নেয়, তা হলে লগ্নি করাই দায় হয়ে উঠবে। সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু টাটা মোটর্স ওই জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ লগ্নি করেছিল। শীর্ষ আদালত টাটা মোটর্সের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ ধার্য করেননি। অথচ টাটা মোটর্স নিজের ইচ্ছেয় যে সিঙ্গুর থেকে সরে আসেনি, তার উল্লেখ রায়েই রয়েছে। শুনানির সময় টাটা মোটর্সের তরফে আবেদন জানানো হয়েছিল, তাদের ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়া হলে তারা সম্মানজনক ভাবে সিঙ্গুরের জমির অধিকার ছেড়ে দিতে পারে। বিচারপতিরা তখনই জানিয়ে দেন, জমি অধিগ্রহণ বেআইনি বলে খারিজ হলে তাদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উঠবে না। যার অর্থ হল, টাটাদের প্রকল্পও আটকে গেল। প্রাথমিক লগ্নির অর্থও জলে গেল।
শিল্পমহলের এই আশঙ্কায় চিন্তিত প্রধানমন্ত্রীর দফতর। কারণ এমনিতেই দেশে নতুন লগ্নি আসছে না। মোদী সরকার বিদেশি লগ্নি আনতে চাইছে। কিন্তু বাস্তব হল, ২০০৮ সালের মন্দার রেশ কাটলেও এখনও দেশীয় শিল্পপতিরা নতুন লগ্নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। প্রথমে তাঁরা চড়া সুদের হারের কথা বলছিলেন। এখন শিল্পমহল বলছে, দেশের বাজারে চাহিদা নেই। বিদেশেও মন্দা। ফলে শিল্প কারখানাগুলিতে যে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে, তা-ই পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। এর সঙ্গে জমি অধিগ্রহণের আতঙ্ক যোগ হলে নতুন লগ্নির সম্ভাবনা একেবারেই কমে আসার শঙ্কা থাকছে।
শিল্পমহল মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গে বিপদের সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। কারণ সিঙ্গুরের মতো পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম খড়্গপুর, পানাগড়, রঘুনাথপুর, সাঁকরাইলের মতো অনেক জায়গায় শিল্প পার্কের জমি অধিগ্রহণ করেছে। সেখানকার কৃষকরাও সিঙ্গুরের রায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মামলা করতে পারেন। রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক শিল্পপতি অবশ্য মনে করছেন, এখনই এতখানি ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ সব জমি অধিগ্রহণের দশাই সিঙ্গুরের মতো না-ও হতে পারে। তাঁর যুক্তি, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে স্পষ্ট, সিঙ্গুরের অধিগ্রহণ আইন মেনে হয়নি। জমির মালিকদের আপত্তি শোনা হয়েছে। কিন্তু আপত্তি কেন খারিজ করে দেওয়া হল, তার যুক্তি দেওয়া হয়নি। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। আইন মেনে অধিগ্রহণ হলে তা আদালতে খারিজ হওয়ার কোনও প্রশ্ন উঠছে না।’’ ওই শিল্পপতির মতে, বাম আমলেই হিডকো রাজারহাট-নিউটাউনে বহু হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। কোথাও কোনও কৃষকদের বিক্ষোভ হয়নি। ফলে সব জায়গা থেকে মামলার আশঙ্কা নেই।
দিল্লির একটি বণিকসভার এক কর্তার মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ইউপিএ সরকারকে নতুন জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইন তৈরি করতে হয়। তদানীন্তন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের তৈরি সেই আইনে এত রকমের শর্ত ও বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ দূরের কথা, সড়ক-সেতু-হাসপাতালের মতো জনস্বার্থের প্রকল্পেও জমি অধিগ্রহণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই কর্তার বক্তব্য, বড় মাপের ভারি শিল্প তৈরি করতে হলে এক লপ্তে ৫০০ থেকে ১০০০ একরের মতো জমি প্রয়োজন। বেশিরভাগ রাজ্যেই সরকার অধিগ্রহণ করে না দিলে ওই পরিমাণ জমি কোনও শিল্পসংস্থার পক্ষে পাওয়া মুশকিল।
এই পরিস্থিতিতে শিল্পের সুবিধা করতে ইউপিএ-জমানার জমি অধিগ্রহণ আইনে বেশ কিছু সংশোধন করে বিল এনেছিল মোদী সরকার। সংসদে সেই বিল বাধা পাওয়ায় একাধিক বার অর্ডিন্যান্স জারি হয়। কিন্তু রাহুল গাঁধী মোদী সরকারকে কৃষক-বিরোধী আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ায় পিছিয়ে আসে মোদী সরকার। সেই জমি আইনে সংশোধনের চেষ্টা এখন হিমঘরে। তার বদলে মোদী সরকার শিল্পমহলের সুবিধার জন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে নিজস্ব জমি আইনে সংশোধন করে নিতে বলেছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলি সেই কাজ সেরে ফেলেছে। কিন্তু আইন করে যে কৃষকদের আন্দোলন ঠেকানো সম্ভব নয়, তা মোদী সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও জানেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy