Advertisement
০৮ মে ২০২৪
জঙ্গলমহল নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা

ফের সংগঠন বাড়াচ্ছে মাওবাদীরা

চাকুলিয়া, পটমদা, সুলিয়াপাদা। পশ্চিমবঙ্গের ভূগোলে একটিও পড়ছে না। কিন্তু মাওবাদী কাজকর্ম নিয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের কণ্ঠস্থ ওই সব নাম।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৫
Share: Save:

চাকুলিয়া, পটমদা, সুলিয়াপাদা। পশ্চিমবঙ্গের ভূগোলে একটিও পড়ছে না। কিন্তু মাওবাদী কাজকর্ম নিয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের কণ্ঠস্থ ওই সব নাম। কারণ, তাঁদের খবর অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরে এই রাজ্যের ফেরার মাওবাদী নেতারা স্কোয়াড নিয়ে ওই সব এলাকা দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ঢুকছে এবং তার পর ফিরে যাচ্ছে সেই পথেই।

এত দিন বৈঠকে, সতর্কবার্তায় এই সব কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু এ বার খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ে তাদের পর্যালোচনায় জানিয়ে দিল, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের কিছু তল্লাটে সংগঠনকে চাঙ্গা করার কাজ পুরোদমে শুরু করেছে মাওবাদীরা।

কাল, সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর সিপিআই (মাওবাদী) তৈরির এগারো বছর পূর্ণ হচ্ছে। ঠিক তার মুখে মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ে ষান্মাষিক পর্যালোচনা রিপোর্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আশঙ্কা করছে, পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড— এই তিনটি রাজ্যের সংযোগস্থলকে নিজেদের কব্জায় আনতে চাইছে মাওবাদীরা। যে কারণে ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া, পটমদা কিংবা ওড়িশার সুলিয়াপাদা ধরে মাওবাদীরা ঢুকছে এই রাজ্যে।

একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই নথিতে বলা হয়েছে, খাস কলকাতায় তাদের কাজকর্ম নতুন ভাবে শুরু করার জন্য ঝাঁপিয়েছে মাওবাদীদের গণ সংগঠনগুলি। এবং সেই লক্ষ্যে জেল থেকে কিছু দিন আগে ছাড়া পাওয়া মাওবাদীদের দু’-তিন জন প্রাক্তন শীর্ষ পদাধিকারী নিয়মিত এখানে যাতায়াতও শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাদের নথিতে কলকাতায় মাওবাদীদের গণ সংগঠন বলতে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে কাজ করা দু’টি সংগঠনকে ইঙ্গিত করেছে।

১৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রকের যুগ্ম-উপ অধিকর্তা ডন কে জোস স্বাক্ষরিত ওই নথিতে এ বছর পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী হিংসার একটিও ঘটনা এখনও ঘটেনি বলে জানানো হলেও এ রাজ্যের পুলিশ ও গোয়েন্দারা উদ্বিগ্ন অন্য কারণে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাওবাদী কার্যকলাপ ও হিংসার ঘটনার নিরিখে ছত্তীসগঢ়ের সঙ্গে প্রায় সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছে ঝাড়খণ্ড। যে রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একেবারে লাগোয়া। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ষান্মাসিক ওই পর্যালোচনা রিপোর্টে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল এলাকাকে মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই তথ্যই দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে এই রাজ্যের পুলিশকর্তাদের কপালে।

রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীরা শক্তিশালী হলে পশ্চিমবঙ্গের বিপদ। এখানে কোনও নাশকতা ঘটিয়ে ঝাড়খণ্ডে গা ঢাকা দেওয়া সহজ। আর সেটা করতে এই রাজ্যে মাওবাদীদের ব্যাপক জনভিত্তিরও প্রয়োজন নেই।’’

ঘাটশিলার বুরুডিহ লেকের কাছে চিকরি গ্রাম লাগোয়া পাহাড়ে মাওবাদীদের একটি ডেরা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে নির্ভুল বাংলায় লেখা বেশ কিছু মমতা-বিরোধী পোস্টার উদ্ধার করেছে ঝাড়খণ্ড পুলিশ। ওই ঘটনার খবর পেয়ে এই রাজ্যের এক শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসার বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ছড়ানোর জন্যই ওই সব পোস্টার লেখা হয়েছিল।’’ তাঁর মতে, গত ১৭ জুলাই তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বেলপাহাড়ির সভায় বক্তৃতা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাওবাদীরা ওই এলাকার চিড়াকুটিতে পোস্টার ছড়িয়েছিল। ঝাড়খণ্ডেরই কোনও তল্লাটে লেখা পোস্টার মাওবাদীরা চিড়াকুটিতে পৌঁছে দিয়ে যায় বলে অভিমত ওই অফিসারের।

গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী নেতা, বাঁকুড়ার বারিকুলের খেজুরখেন্না গ্রামের রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলের অনুগামীরা বুরুডিহ লেকের কাছে ঘাঁটি গেড়েছিল। একটা সময়ে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল সম্প্রতি বেলপাহাড়িরই শিমুলপাল অঞ্চলের পাথরচাকরি ও শাখাভাঙায় সদলবল এসেছিল বলেও গোয়েন্দাদের দাবি। ওই তল্লাট থেকে পোস্টার পড়া চিড়াকুটি যেমন কাছে, তেমনই ঝাড়খণ্ডও পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে।

ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া, ঘাটশিলার মতো এলাকা বেলপাহাড়ির লাগোয়া। আবার পুরুলিয়ার বরাবাজার ও বান্দোয়ান এলাকার গা ঘেঁষে ঝাড়খণ্ডের পটমদা। যেখানে শচীন নামে এক মাওবাদী নেতা ও তার স্কোয়াডের নিয়মিত গতিবিধির খবর গোয়েন্দাদের কানে এসেছে।

বেলপাহাড়ির মতো পশ্চিমবঙ্গের আর এক একটি মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা নয়াগ্রাম। তবে সেটা ঝাড়খণ্ড নয়, ওড়িশা লাগোয়া। নয়াগ্রামের ও পারেই ওড়িশার সুলিয়াপাদা এলাকা। যেখান থেকে মাওবাদীরা মোটর সাইকেলে চড়ে নয়াগ্রামের পাতিনা, রাঙামেটিয়ার মতো তল্লাটে ঢুকে তাদের পুরনো সমর্থকদের বাড়িতে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

সিআরপি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘মাওবাদীরা পশ্চিমবঙ্গের সে সব জায়গায় ঢুকছে, যেখান থেকে চট করে ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশায় ঢুকে পড়া যায়।’’

কলকাতায় গত জুনে এই রাজ্যে পুলিশ, কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সমন্বয়-বৈঠকে উঠে এসেছে, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা এবং তারা ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া লাগোয়া কয়েকটি এলাকায় প্রায় নিয়মিত আনাগোনা শুরু করেছে। এর পর অগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এক সতর্কবার্তায় জানায়, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর বড় ধরনের হামলা চালানোর ছক কষেছে মাওবাদীরা। আর এ বার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই পর্যালোচনা রিপোর্ট।

তবে মন্ত্রকের বক্তব্য, এ-ই প্রথম পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নিহত মাওবাদীদের সংখ্যা তাদের হাতে নিহত পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যার চেয়ে বেশি। এ বছর এখনও পর্যন্ত মাওবাদীদের হাতে নিহত পুলিশ-নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা ৩৯। নিহত মাওবাদীর সংখ্যা সেখানে ৪০। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, নির্ভুল গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট অভিযানই এই সাফল্যের কারণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jangalmahal Special report Maoist activities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE