• ২০১০ সালের ১১ অগস্ট খুন হন তৃণমূল কর্মী বদরে আলম
• অভিযুক্ত সিপিএমের জোনাল সম্পাদক-সহ ৮৪ জন, ধৃত ১৫
• সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব এখনও মেটেনি
• খুনের কারণ এখনও স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে
রাজ্যজুড়ে তখন পালাবদলের প্রতীক্ষা চলছে। এলাকা দখল নিয়ে তখন সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে চলছে ধুন্ধুমার লড়াই। বোমা, গুলির শব্দে মাঝে মধ্যেই কেঁপে উঠছে পাত্রসায়র। তেমনই এক সকালে মুখে গামছা, হাতে বোমা ভর্তি ব্যাগ, লাঠি নিয়ে কয়েকশো লোক ডিভিসি-র ক্যানাল পাড় ধরে এগিয়ে আসছিল। কয়েকজনের হাতে বন্দুক।
চমকে উঠেছিল ফকিরডাঙা, খয়েরবুনি, বামুনপুকুর গ্রাম। বোমা, গুলির শব্দে ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন বাসিন্দারা। গরুর হাটে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন বামুনপুকুরের সক্রিয় তৃণমূল কর্মী বদরে আলম (৫২)। রাস্তায় বন্দুকবাজদের দেখেই দৌড়ে বাড়ি ঢুকে দোতলার ঘরে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু ধাওয়া করে বাড়িতে ঢুকে বন্দুকবাজেরা গুলিতে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। মাথা-বুক-পিঠ মিলিয়ে অন্তত গোটা সাত-আট গুলি বিঁধেছিল শরীরে।
২০১০ সালের ১১ অগস্টের সেই সকালেই যেন থমকে গিয়েছে বামুনপুকুরের বদরে আলমের পরিবার। অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া ইটের দোতলা বাড়ির উপরতলার ডানদিকের ঘরেই পড়েছিল দেহ। এখন সেই ঘর দিনরাত শিকল দেওয়া থাকে। বাড়ির লোক সে ঘরে রাতে থাকেন না। ‘‘ঘরে ঢুকলেই ওঁর কথা মনে পড়ে যায়। তাই আর ঢুকি না’’— কান্নাভেজা গলায় বলেন বদরে আলমের স্ত্রী সিদ্দিকা বিবি।
পুলিশ সূত্রের খবর, সে দিন গরুর হাটে যাওয়ার পথে বাড়ির কাছেই বদরে আলমের সঙ্গে সিপিএম আশ্রিত বহিরাগত দুষ্কৃতীদের কথা কাটাকাটি হয়। দুষ্কৃতীরা তাড়া করলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে বাড়ির চিলেকোঠায় উঠে খিল এঁটে দেন। বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর চালায়। বেধড়ক মারধর করা হয় পড়শি মফিজুল মিদ্যাকে। শেষে চিলেকোঠায় উঠে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে খুন করে বদরে আলমকে।
ওই খুনের পরই তেতে উঠেছিল গোটা এলাকা। সোনামুখীর সার্কেল ইনস্পেক্টরের গাড়িতে সিপিএমের পতাকা বেঁধে দেন উত্তেজিত তৃণমূল কর্মীরা। গাফিলতির অভিযোগে ‘ক্লোজ’ করা হয় পাত্রসায়র থানার তদানীন্তন ওসি সুমন্ত অধিকারীকে। সিপিএমের পাত্রসায়র জোনাল কমিটি সম্পাদক লালমোহন গোস্বামী, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মোজাম্মেল হক-সহ ৮৪ জনের বিরুদ্ধে পাত্রসায়র থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন নিহতের ছেলে শেখ চাঁদ আলম। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই খুন, সংঘর্ষ ও অস্ত্র আইনের একাধিক ধারায় মামলা রুজু হয়। কেস নাম্বার ৫১/১০।
তদন্তে নেমে এফআইআরে নাম থাকা অভিযুক্তদের ১৫ জনকে ধরে পুলিশ। আদালতে আত্মসমর্পণ করে পাঁচ জন। দুই অভিযুক্ত পলাতক অবস্থায় মারা যায়। ৬২ জন আদালত থেকে জামিন পায়। এই খুনের পরেই এলাকায় সংঘর্ষ মাত্রা ছাড়ায়।
ঘটনার প্রায় এক বছর পরে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। ধৃতেরা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব। ফের বিধানসভা ভোট চলে এল। কিন্তু বিচার তো দূর, কারা খুন করল পেশায় গরু ব্যবসায়ী বদরে আলমকে তা প্রমাণিত হয়নি আজও। তৃণমূলের কর্মী হলেও সেই অর্থে এলাকায় তাঁর যে বিরাট প্রভাব ছিল তেমনটা নয়। তা হলে কেন তাঁকে খুন করা, তা রহস্যই। তদন্তে নেমে পুলিশ খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। চার্জশিটে ধৃতদের বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণও মেলেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এমন হল কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘নিহতের পরিবার আততায়ীদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেনি। ধৃতদের জেরা করেও খুনের কারণ স্পষ্ট হয়নি। ফলে, চার্জশিটও ওই রকম হয়েছে।’’
অভিযুক্তদের তরফে সিপিএমের পাত্রসায়র জোনাল সম্পাদক লালমোহন গোস্বামীর এখনও দাবি, “রাজনৈতিক কারণে তৃণমূল বদরে আলমের পরিবারকে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছে। আদালতে সেটাই প্রমাণ হয়ে যাবে।”
বদরে আলমের ছেলে সাদরে আলম বলেন, ‘‘বাবা প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই জন্য ওঁকে মেরে সবার সামনে দিব্যি বুক ফুলিয়ে চলে গেল ওরা।’’ একটু থেমে বলেন, “বাবা তৃণমূল করতেন। এটাই কি ওঁর অপরাধ ছিল? রাজ্যে শাসক বদলের পরেও কই বাবার খুনিদের সাজা তো হল না! ”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy