Advertisement
০৩ মে ২০২৪

কী লিখি না ভেবে শুরু হোক লেখা

কিছুদিন আগেও আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল এমন অনেক কিছু, আজ যা হারাতে বসেছে। চিঠি লেখা তেমনই এক। আর্ট ছিল এক সময়।

স্নেহাংশু চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:১৯
Share: Save:

শেষ কবে হাতে চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলেছেন, এ প্রশ্ন করলে অনেকেই মাথা চুলকোবেন। দোষ দিই না তাঁদের।

কিছুদিন আগেও আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল এমন অনেক কিছু, আজ যা হারাতে বসেছে। চিঠি লেখা তেমনই এক। আর্ট ছিল এক সময়। আর আজ চিঠি কেন, মোবাইল-সর্বস্ব জীবনে লেখার অভ্যাসটাই যেতে বসেছে। মনে করে বলুন তো, শেষ কবে লিখেছেন? মোবাইলের স্ক্রিনে নয়, কাগজ-কলম সহযোগে? ‘হয়ে ওঠে না’, বলবেন অনেকেই। অজুহাত আসবে সময়ের অভাবের। আসল কথা হল অভ্যাস। ছোটবেলায় যে অভ্যাসটা ছিল, আজ আর তাতে শান দেওয়া হয় না। বহু দিন চর্চা না করার ফলে এখন আত্মবিশ্বাসটাই নড়ে গিয়েছে।

আমরা মোবাইলের স্ক্রিনকেই চোখের ঘর বানিয়েছি। বাসে, ট্রেনে, অটো এমনকী টোটোতেও লম্বা কিংবা স্বল্প সফরে কিছুদিন আগেও যাত্রীদের অনেকের হাতে থাকত বই, নিদেন পক্ষে খবরের কাগজ। সেই জায়গাও নিয়েছে মোবাইল। বাসে বা ট্রেনে উঠলেই দেখা যায়, বেশির ভাগের ঘাড় নিচু। দু’হাতের বুড়ো আঙুলই অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ঘোরাফেরা করছে স্মার্টফোনের পর্দায়!

লেখা শুধু নয়, বই পড়াও কি কমে যায়নি? কমেছে বই কেনার অভ্যাসও। বই তো এখন ‘পিডিএফ ভার্সনে’ নেট দুনিয়ায় সদাই মিলছে। কিন্তু, বইয়ের যে একটা গন্ধ আছে, উত্তেজনা আছে, বই হাতে নিয়ে অনুভব করে পড়ার যে মজা, তা কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে পাওয়া যায় না। তবু আশা যে, মানুষজন বই পড়ছেন। নিদেন পক্ষে বই সংগ্রহ করার অভ্যেস বাঙালির এখনও তলানিতে ঠেকেনি। নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস তো বইয়েরই মাস, বইমেলার মাস। সে-সব জায়গায় স্থান সঙ্কুলানের কমতিই জানান দেয়, বই পড়া নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও নিরাশাব্যঞ্জক অনভ্যাস তৈরি হয়নি।

কিন্তু লেখার থেকে আমরা বোধ হয় একটু পিছিয়েই রয়েছি। আমরা যেন মনে করি ওটা কবি-লেখকদেরই কাজ। আদি হতে অদ্য, বঙ্গের লেখক ও কবিরা যথেষ্ট উচ্চমানের রচনা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। কিন্তু আমরা গড়পড়তা বাঙালিরা ‘খাতা কলম মন-লেখে তিন জন’ থেকে তিনশো যোজন দূরে চলে গিয়েছি। তবে লেখার অভ্যাস নতুন ভাবে তৈরি করাই যায়। শুধু চাই একটু ধৈর্য আর নিয়মানুবর্তিতা।

লেখার জন্য পড়তে হবে। কোনও বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নিজের উপলব্ধি লিখে ফেলুন। হোক সেটা দুই বা চার কথায়। আজ যদি দু’কথা দিয়ে শুরু হয়, কাল চার কথায় প্রকাশ করা কঠিন নয়। প্রতিদিন অল্প অল্প করে লিখুন। দিনের একটা সময় থাকুক না এর জন্য আলাদা করে রাখা। ভাল লিখতে পারাটা একটা বিশেষ গুণ। নিজের ভাবনাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়াও কিন্তু শিল্প। যে বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন, আপনার মস্তিষ্কের ভিতরে যে ‘এক্সারসাইজ’ চলছে লেখার জন্য, সেটাই আপনাকে নতুন নতুন ভাবনার রসদ জোগাবে। যা চিন্তায় আসে আবোল তাবোল, ঠিক-ভুল না ভেবে লিখে ফেলুন পাণ্ডুলিপি হিসেবে। যখন পুরো লেখাটা এক সঙ্গে দেখবেন তখন নিজেই বুঝতে পারবেন কতটুকু প্রাসঙ্গিক, কতটা নয়। কত পরিমিত ভাবে স্বল্প পরিসরে আপনি আপনার মনের ভাব যৌক্তিক ও অর্থবহ ভাবে প্রকাশ করতে পারছেন, সেই লিটমাস টেস্টও লিখনের মাধ্যমেই হয়ে যায়।

তাই লিখতে শুরু করুন। তবে আপনার পাঠকবর্গ কারা সেটা প্রথমে দেখে নিন। বিষয় নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্রুত চলমান সমাজে বস্তাপচা সাবেক লেখা পড়া বা শোনার মতো আগ্রহ কারও নেই। তাই লেখা হতে হবে পরিশীলিত, মেদবর্জিত। অদরকারি গল্প কথা কেউ শুনতে চায় না আজকাল। তাই অল্প চিন্তা করার পরেই লিখতে শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অনেকেই আছেন যাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি বিরাট। লিখতেও চান। কিন্তু, ‘শুরুটা কী ভাবে করব’, এই দোটানায় ভোগেন। অনেকে আবার পত্র-পত্রিকায় লিখতে চান।
লেখেনও ভাল। কিন্তু, আত্মবিশ্বাসের অভাব গল্পের শুরুতেই নটে গাছটি মুড়িয়ে যেতে বাধ্য করে। তাঁদের বলি, লেখাটা না হয় ডায়েরি দিয়েই শুরু হোক। সেটা তো আপনার একান্ত ব্যক্তিগত।

আগে ডায়েরি লেখার অভ্যেস অনেকের মধ্যেই ছিল। এখন যেমন হেমন্তকাল শুধু নামেই জানান দেয়। ডায়েরি লেখাও আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। ইংরেজি বছরের শুরুতে দোকানে ডায়েরি বিকোয় বটে। কিন্তু বছরের শেষে ক’টা ডায়েরি ঠিক অর্থে শেষ হয়েছে, তা হাতে গোনা যাবে। এই সহজলভ্য উপায় দিয়েই শুরু হোক না আমাদের লেখার অভ্যাস। ডায়েরি লেখার বেশ কিছু সুফলও আছে। আগামী কালের কাজের সূচিপত্র মনে রাখার সবচেয়ে সহজ ও গ্রহণযোগ্য উপায় অবশ্যই ডায়েরি। হয়তো প্রথমে চার লাইনের বেশি এগোনোই গেল না। ক্ষতি নেই। যে কোনও জিনিসের শুরু এ ভাবেই হয়। ডায়েরি লেখার অভ্যাস থাকলে পুরনো সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করা সম্ভব। উপায় আরও আছে। বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা বেড়াতে গিয়ে আমরা সকলেই ছবি তুলে থাকি। বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সেই সব ছবি দিয়েও থাকি। সেই ছবিগুলো এক কপি করে ডায়েরিতে চিটিয়ে নিয়ে দু’কলম লিখলেও বেশ হয়। অনেক দিন পরে নিজের হাতের লেখার স্মৃতির পাতা উল্টে নেওয়ার অনুভূতিই আলাদা। সেই অনুভূতি মোবাইলে নেই। সেখানে পাতা উল্টানোর শব্দ যে নেই!

স্যর ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘রিডিং মেকেথ অ্য ফুল ম্যান। কনফারেন্স অ্য রেডি ম্যান। অ্যান্ড রাইটিং অ্যান এগ্‌জ্যাক্ট ম্যান।’ সুতরাং লেখার অভ্যাস গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে পারে আপনার চরিত্রে। তাই শুরু হোক লেখা। ধীরে ধীরে দেখবেন ভাবনার ঘরে নতুন স্তর জমা হচ্ছে। কত নতুন শব্দের আনাগোনাও।

লেখক দুর্গাপুরে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

writing skill Virtual Medium
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE