Advertisement
০৫ মে ২০২৪

নেই-শিল্পের বাংলায় মহাশিল্প মাছ চুরি

শিল্প-খরার বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্যে মুড়ি-তেলেভাজাও শিল্প। তাতে তবু বিনিয়োগ কিছু করতেই হয়। কিন্তু এমন এক মহাশিল্পের খোঁজ মিলেছে, যাতে লগ্নি লাগে না। সবটাই মুনাফা। শিল্পের নাম মাছ চুরি!

কাজল গুপ্ত ও মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

শিল্প-খরার বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্যে মুড়ি-তেলেভাজাও শিল্প। তাতে তবু বিনিয়োগ কিছু করতেই হয়। কিন্তু এমন এক মহাশিল্পের খোঁজ মিলেছে, যাতে লগ্নি লাগে না। সবটাই মুনাফা। শিল্পের নাম মাছ চুরি!

ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে চুরি হল চৌষট্টি কলার এক কলা। এবং যাহা কলা, তাহাই শিল্প! চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা। তা, মাছ চুরির সেই শিল্পচর্চায় নেমে ধরা পড়লে নাক কাটা যাওয়ার ঝকমারিও প্রায় নেই। কেননা ছোট-বড়-মেজো-সেজো ‘দাদা’র পায়ে প্রণামী পৌঁছে যায় নিয়মিত। তাই ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট প্রায় শূন্য। যেটুকু থাকে, সামলে দেন দাদারা। শিল্প সম্প্রসারণও করা যায় অনায়াসে। বিনিয়োগ ছাড়াই। লাভের হিসেবটাও মাস বা বছরের মাপে করতে হয় না। দিনের দিন হাতে হাতে নগদপ্রাপ্তি। যথাস্থানে দিয়েথুয়ে রোজ দশ হাজার থেকে তিন-চার লক্ষ টাকা হাতে আসে হেসেখেলে।

তা হলে আর চিন্তা কী? চিন্তা চোরেদের বা তাদের নিয়মিত নৈবেদ্য পাওয়া দাদাদের নেই ঠিকই। কিন্তু রাজ্যের ভাঁড়ারের চিন্তা বাড়ছেই। মাছ চুরি মাত্রা ছাড়ানোয় একই সঙ্গে ভাঁজ বাড়ছে মৎস্য দফতরের কর্তা এবং বেসরকারি ভেড়ির মালিকদের কপালে। কেননা মাছের উৎপাদন বাড়লে সরকারি ভাঁড়ার বা ভেড়ি-মালিকের ঘরে যতটা লভ্যাংশ জমা পড়ে, চুরির রমরমায় তা পড়ছে না।

মাছ চুরি কি বিগত জমানায় হতো না? হতো। লুকিয়েচুরিয়ে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত চার বছরে শাসক দলের গোষ্ঠী-কোন্দলের দৌলতে সেটা শিল্পের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে! এক গোষ্ঠী দশ চোর নামায় তো বিশ চোর নামিয়ে টেক্কা দেয় অন্য গোষ্ঠী। এ ভাবে উৎপাদিত মাছের পাঁচ ভাগের এক ভাগই চুরি যাচ্ছে।

ভেড়ি এলাকার তৃণমূল নেতারা অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, মাছ চুরি দীর্ঘদিনের ব্যাপার। যারা করে, তারা চোরই। এবং তাদের সঙ্গে শাসক দলের কোনও যোগ নেই।

রাজ্যের মৎস্য উন্নয়ন নিগমের অধীনে ১৪টি বড় জলাশয় রয়েছে। নিগম গত বছর ১৪০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করেছে। সেখানকার এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘আমাদের যা মাছ চাষ হয়, তার কুড়ি শতাংশ চুরি হয়ে যায়।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের জুনপুটে ৫৮ হেক্টর জলাশয় আছে সরকারের। মৎস্য দফতর সূত্রের খবর, জুনপুটে ২০১৪-’১৫ থেকে ২০১৫-’১৬ সালে মাছ চাষ করে ২৮ লক্ষ টাকা আয় হয়েছে। চুরি ঠেকানো গেলে আয় ৫০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যেত। সারা দেশে মাছ উৎপাদনে অন্ধ্রপ্রদেশ প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। মৎস্য দফতরের কর্তাদের কথায়, মাছ চুরি ঠেকানো গেলে সারা দেশের গড় উৎপাদনের নিরিখে অন্ধ্রকে টেক্কা দিতে পারত বাংলা। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে বাংলার প্রথম হওয়ার পথে কাঁটা মাছচোরেরাই।

কী ভাবে চুরি যাচ্ছে মাছ?

ই এম বাইপাস সংলগ্ন গোলতলায় ১১০ হেক্টর এলাকায় মাছ চাষ করে মৎস্য নিগম। সপ্তাহ দুয়েক আগে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সেখানে জাল ফেলে কিছু দুষ্কৃতী। খবর পেয়ে দু’জন নিরাপত্তারক্ষী নৌকা নিয়ে এগোতে যেতেই ইট ছুড়তে শুরু করে দুষ্কৃতীরা। সেই সঙ্গে হুমকি। প্রাণের ভয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন রক্ষীরা।

চুরির পদ্ধতি আর চুরির মাছ বিক্রির সাতকাহন জানালেন ভেড়ি-শ্রমিকেরাই। তাঁরা জানাচ্ছেন, টানা জাল হলে ৯-১০ জন চোরের দরকার হয়। পাতন জাল ফেললে ২-৪ জন চোর হলেই চলে। টানা জালে চুরি করা মাছের জন্য বাজারচলতি দামের কাছাকাছি দর পাওয়া যায়। কিন্তু পাতন জালে তোলা মাছে দাগ থাকে বলে টাকা মেলে কম। ভেড়িতে এক বার জাল ফেলে ৪-৫ কুইন্টাল মাছ তুলে নেয় চোরেরা। ভোরেই তা চলে যায় ‘কাঁটা’য়, আড়তে। যেমন, সল্টলেক এলাকার ভেড়ি থেকে চুরি করা মাছের একটা অংশ বিক্রি হয়ে যায় বেলেঘাটা-তিলজলা এলাকায়। চুরিতে এক শ্রেণির ভেড়ি-শ্রমিকের সক্রিয় যোগ আছে, জানাচ্ছেন কর্তারা। রাতারাতি লক্ষাধিক টাকা রোজগার। পুলিশ আর রাজনৈতিক দাদাদের প্রণামী দিয়েও হাতে থাকে অনেকটাই। তাই চুরির দিকে ঝুঁকে পড়েন অনেক ভেড়ি-শ্রমিকও। কারণ শ্রমিকের হাড়ভাঙা খাটুনিতে মজুরি হিসেবে যা মেলে, মাছ চুরিতে নামলে তার বহু গুণ বেশি টাকা আসে।

মাছ চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?

মৎস্য নিগমের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পরিবেশের স্বার্থে বিশাল জলাশয়ে আলো জ্বালানো যাচ্ছে না। তা ছাড়া বড় জলাশয়ে মাছ চুরি ঠেকানোর জন্য মোটরচালিত নৌকা দরকার। পরিবেশের জন্য সেই নৌকা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।’’ তিনি জানান, যত রক্ষী দরকার, তা নেই। বরাদ্দও বাড়ানো হচ্ছে না। জুনপুটে ৫৮ হেক্টরের জলাশয়ের ৮০ শতাংশ জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। রাতে দুষ্কৃতী ঠেকাতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছিল। দুষ্কৃতীরাই তা খুলে নিয়ে গিয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। জুনপুটে রক্ষী আছেন ১০ জন। চুরি ঠেকাতে চার ধার ঘিরে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটা হয়নি।

কর্তারা পরিবেশগত বাধার কথা বলছেন, পরিকাঠামোর অভাবের কথা বলছেন। তবে প্রশাসনিক সূত্রেরই খবর, চুরি আটকাতে গেলে যে-সব পদক্ষেপ করা যায়, তা করা যাচ্ছে না মূলত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে। এক কথায় দাদাদের চাপ। তাই সরকারি ভেড়ি হোক বা বেসরকারি, মাছ চুরি ঠেকানোর উদ্যোগ সশস্ত্র কর্মী বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ। সেই রক্ষীরাও মাছ চুরি রুখতে গিয়ে জান খোয়ানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নন। রক্ষী বা শ্রমিকেরা চুরির প্রতিবাদ করলে মৃত্যু অনিবার্য। গত সাত মাসে সল্টলেকের ভেড়ি এলাকায় দু’জন ভেড়ি-শ্রমিক খুন হয়ে গিয়েছেন।

মাস ছয়েক আগে নলবনে মাছ চুরির ঠেকাতে গিয়ে খুন হন নিগমের কর্মী গোপাল বর। বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা হতেই সেই মামলার দুই অভিযুক্ত জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। নলবনের এক নিরাপত্তারক্ষীর কথায়, ‘‘মাছ চুরির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হলেন নিগমকর্মী। অথচ অভিযুক্তেরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেল। এর পরে আমরা মাছচোরেদের ধরতে সাহস পাব কী ভাবে?’’

জবাব জানা নেই নিগমের। এক নিগম-কর্তার পাল্টা প্রশ্ন, চোরেদের মাথায় রাজনৈতিক দাদাদের হাত থাকলে বেপরোয়া চুরি আটকাবে কে? চোরেরা শাস্তি না-পেলে রক্ষীরা চুরি আটকানোর সাহস পাবেন কী ভাবে?

তা হলে?

প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের দাওয়াই: প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শ্রমিক-সমবায় গড়ে তাদের হাতে ভেড়ির ভার দিলে সুরাহা হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE