সানাউল্লা রহমানি
চাকরি পাওয়ার আগে আট বছর ধরে ছাত্র পড়িয়েছি। ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেদের ব্যবহার এমন হতে পারে, ভাবতে পারিনি কোনও দিন।
ওই মুহূর্তগুলোর কথা ভাবলে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। আতঙ্কে নয়, দুঃখে। চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি, ওরা হুমকি দিচ্ছে: সাদা কাগজে সই করুন! লিখে দিন এখানে চাকরি করতে চান না! নইলে...
১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর। দাড়িভিটের স্কুলে ওই দিনই প্রধান শিক্ষক ডেকে পাঠিয়েছিলেন ‘জয়েনিং লেটার’ দেওয়ার জন্য। আমি উর্দুর, আমার সঙ্গে সংস্কৃত শিক্ষক তৌরঙ্গ প্রধান। প্রধান শিক্ষকের ঘরেই বসেছিলাম। চার-পাঁচ জন ছাত্র ঢুকে ওঁকে বলল, ‘‘আপনি যে আগে বলেছিলেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে না! তা হলে?’’ উনি ওদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অল্পক্ষণ পরে এক জন শিক্ষক এসে আমাদের স্টাফরুমে নিয়ে গেলেন। তখনই দেখলাম, প্রধান শিক্ষক চার জন পুলিশ কর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন। স্টাফরুমে তখন আরও দু’জন শিক্ষক। সেখানে গিয়ে বসতেই এ বারে বাঁশ, রড, শাবল নিয়ে ছ’সাত জনের একটা দল ঘরে ঢুকে আমাদের শাসাতে লাগল। তাকিয়ে দেখি ঘরে আর কেউ নেই।
আরও পড়ুন: আন্দোলনের রং নিয়ে দু’ভাগ দাড়িভিট
মুখের সামনে একটা লোহার রড ধরে স্কুলের পোশাক পরা ওই ছেলেরা বলতে থাকে, ‘‘এটা শাবল।’’ একটা বড় বাঁশের লাঠি দেখিয়ে
বলে, ‘‘এটা ডান্ডা। এগুলোর ব্যবহার হলে আপনাদের অবস্থা কী হবে বুঝছেন?’’ কী চায় ওরা? আমাদের সাদা কাগজে লিখে দিতে হবে, আমরা চাকরি করতে চাই না!
তৌরঙ্গ বাংলায়, আমি ইংরেজিতে লিখলাম। লিখেছিলাম, ‘‘চাপের মুখে আমরা এই চাকরি নিতে পারছি না।’’ তাতে ওরা রাজি নয়। লিখে দিতে হবে, ‘‘আমরা স্বেচ্ছায় চাকরি নিচ্ছি না!’’ তা-ই করলাম। কাগজটা দেওয়ার সময় হাতজোড়় করে বললাম, ‘‘এটা লিখলে আর চাকরি পাব না। সেটা একটু ভাবুন।’’ ওরা কাগজটা নিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এর পরই পুলিশ আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তার পর বেশ কিছুক্ষণ কী হয়েছে, আর জানতে পারিনি।
ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ যখন আমাদের নিতে এল, বাইরে বেরিয়ে দেখি এক শিক্ষক অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছেন। প্রধান শিক্ষক আর কিছু ছাত্র তাঁর শুশ্রূষা করছেন। ক্যাম্পাস ফাঁকা। কিন্তু পাঁচিলের বাইরে গোটা চত্বরটা ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মুখ। ইট পাটকেল উড়ে আসছে। তার মধ্যে দিয়েই পুলিশ আমাদের একটা ভাঙাচোরা জিপে তুলল। গাড়িটা ভাঙা কাচে ভর্তি। ইসলামপুরে একটা হোটেলে নিয়ে এল পুলিশই।
মঙ্গলবার বাড়ি ফিরেছি। চার দাদা মাদ্রাসা স্কুলের শিক্ষক। আলাদা থাকেন। দিদিদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে খিদিরপুরে থাকি। নিজের যোগ্যতায় স্কুল সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। চাকরিটা খুব দরকার ছিল। মুখ্যমন্ত্রী আর শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সব বলব। তবে আট বছর প্রাইভেট টিউশন করেছি আমি। প্রায় শ’দুয়েক ছেলেমেয়ে পড়িয়েছি। ছাত্রদের এমন রূপ দেখিনি। ছাত্রদের তাড়ায় পুলিশকে পালাতেও আগে দেখিনি। ওদের নিশ্চয় মগজ ধোলাই করে পাঠিয়েছিল কেউ।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: শুভাশিস ঘটক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy