Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
BJP

‘লিখে নিন, আর কোনও বিজেপি কর্মী খুন হবে না, কী ভাবে রুখতে হয় দেখাব’

ধর্মশালার সামনের বিশাল মাঠের উল্টো দিকেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাঠ পেরিয়ে মোদীর মূল দরজার সামনে পৌঁছনোর আগেই গা ঘেঁষে প্রায় ধুলোর ঝড় তুলে চলে গেল গোটা পাঁচেক বাইকে সওয়ার ১২-১৩ জন যুবক।

বিরিঞ্চি কুমার।—নিজস্ব চিত্র।

বিরিঞ্চি কুমার।—নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৮ ১৩:১৭
Share: Save:

প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ফোনটা এল। উল্টো দিক থেকে খাঁটি পুরুল্যা টানে একটাই বাক্য— “মোদীর সামনে এসে দাঁড়ান।” তত ক্ষণে বলরামপুরে কয়েক ঘণ্টা কাটানোর সুবাদে জেনে গিয়েছি, ‘মোদী’ বলতে এলাকার মানুষ জামশেদপুর রোডের উপর মোদী ধর্মশালাকেই বোঝেন।

ধর্মশালার সামনের বিশাল মাঠের উল্টো দিকেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাঠ পেরিয়ে মোদীর মূল দরজার সামনে পৌঁছনোর আগেই গা ঘেঁষে প্রায় ধুলোর ঝড় তুলে চলে গেল গোটা পাঁচেক বাইকে সওয়ার ১২-১৩ জন যুবক। সব ক’টা বাইক গিয়ে থামল মোদীর গেটের সামনেই। ধর্মশালার মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই শান বাঁধানো উঠোন। তার চার দিকে সারি দিয়ে ঘর। ওই যুবকদের কয়েক জন একটা ঘর থেকে কয়েকটা চেয়ার আর দুটো চারপাই বের করে, উঠোনে নামিয়ে বসার ব্যবস্থা করে ফেলল।

তত ক্ষণে আমার দিকে নজর পড়েছে ওদের কয়েক জনের। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম— ‘‘বিরিঞ্চি বাবু?’’ এ বার যুবকদের মধ্যে এক জন এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “আপনিই ফোন করেছিলেন বিরিঞ্চিদা-র সঙ্গে দেখা করতে?” মাথা নাড়তেই, যুবকদের জটলা একটু সরে গেল। পিছনে একটা চেয়ারে বসা সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ। হাত তুলে সামনের চারপাইতে বসতে ইশারা করে বললেন, “আমিই বিরিঞ্চি।”

আরও পড়ুন
পুজোর আবেগে ঘা লাগলে মানুষ ছেড়ে দেবে?
মমতার দিকে আঙুল তুললেন বিস্ফোরক সৃষ্টিধর

হতাশই হলাম। কলকাতা থেকে রওনা দেওয়ার আগে থেকে শুনে আসছি, বলরামপুরে তৃণমূল কংগ্রেসকে নির্বাচনে উড়িয়ে বিজেপি-র এই জয়জয়াকারের মূল কারিগর নাকি বজরং দল বা বি‌শ্ব হিন্দু পরিষদের মতো আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলি। তাই সকালে বলরামপুর ঢোকার আগে থেকেই চেষ্টায় ছিলাম বলরামপুরের বজরং নেতাদের সঙ্গে দেখা করার। সেখান থেকেই বিরিঞ্চি কুমারের খোঁজ শুরু। তিনিই বলরামপুরে বজরং বলের প্রধান। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর যোগাযোগ করতে পেরেছি। কিন্তু আশা করেছিলাম এক জন বেশ রাসভারী মাঝবয়সী নেতাকে দেখতে পাব। তার বদলে এই সদ্য কৈশোর পেরোন তরুণ!

বিজেপির এই পতাকা তাদের জোরেই উঠেছে, দাবি বজরঙ্গ দলের।

উল্টোদিক থেকে তত ক্ষণে একদম চাঁছাছোলা গলায় প্রশ্নটা ভেসে এল, “বলুন কী জানতে চান?”

জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে নাকি বিজেপির ভাল ফলের জন্য আপনাদের সংগঠনের অনেক অবদান আছে? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে মুখ খুললেন বিরিঞ্চি, “অনেকটা নয়। সবটাই। এখানে বিজেপি বলে কিছু নেই। আপনি তো জানেন আরএসএসের রাজনৈতিক মুখ হল বিজেপি। কিন্তু তার চালিকা শক্তি তো আমরা। আমরাই সংগঠন করি এখানে। বিজেপিকেও আমরাই এখানে বাঁচিয়ে রেখেছি।”

আরও পড়ুন
‘জিতে ফিরলে ওরা হাত কেটে নেবে বলেছিল’

কাটা কাটা এই উত্তর শুনে খুঁটিয়ে দেখতেই হল সামনে বসা যুবকটিকে। পরনে নীল সিল্কের পাঞ্জাবি আর জিন্স। চুল-দাড়ির স্টাইলে এক ঝলকে বিরাট কোহালির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কপালে গেরুয়া সিঁদুরের টিপ। গলায় জড়ানো গেরুয়া গামছা। ডান হাতে মোটা রুপোর চেন। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে নজর কাড়ে আত্মপ্রত্যয়ী, কিছুটা উদ্ধত চোখ। আগের কথার রেশ ধরেই বিরিঞ্চি বলেন, “এখানে বিজেপির হয়ে কারা প্রার্থী হবে সেটা আমরাই ঠিক করেছি। তাঁদের জিতিয়ে এনেছি।”

পাশ থেকে তাঁর এক সঙ্গী এ বার মুখ খুললেন, “আমরা না থাকলে তো স্ক্রুটিনির দিনই সব শেষ করে দিত সৃষ্টিধর। আমরা পাল্টা মারতেই তো ওরা পালাল।”

রহস্যময় ভাবে মৃত বিজেপি কর্মী ত্রিলোচনের গ্রাম সুপুরডিতে তৈরি হচ্ছে এই মন্দির।

সেই মামলা এখনও ঝুলছে ২১ বছরের এই বিরিঞ্চির মাথায়। পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করতেই হেসে উঠল বিরিঞ্চি, “কলেজে তো ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পর পর কেস খেলাম। পুরুলিয়া, বাঘমুণ্ডি সব গন্ডগোলে পুলিশ আমার নাম জড়াল। তাই কিছু দিন ঝাড়খণ্ডে পালালাম।” সংগঠন নিয়ে প্রশ্ন করতেই বিরিঞ্চির সাফ জবাব, “দাদা, আমি বা আমার সঙ্গে এক ডাকে বেরিয়ে আসে যে হাজার পনেরো ছেলে, তারা কেউ রাজনীতি করে না। আমরা শুধু হিন্দুত্বের জন্য সংগঠন করি। আমার সংগঠন বলেছে তাই বিজেপিকে ভোটে জিতিয়েছি। সংগঠন নির্দেশ দিয়েছে তাই নিজেও ভোটে দাঁড়িয়েছি। পঞ্চায়েত সমিতিতে জিতেছি। তার মানে ভাববেন না আমি বিজেপি করি। বিজেপি যত ক্ষণ আমাদের আদর্শ-নীতি মেনে চলবে তত দিন আমরাও বিজেপির সঙ্গে থাকব। আর যে দিন মানবে না সে দিন আমরাও বিজেপির সঙ্গে নেই।” মোদী ধর্মশালার মাঠের উল্টোদিকে বিজেপির বলরামপুর কার্যালয়। বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় সেখানে মাইকে বক্তব্য রাখছেন। সামনে বসা বিরিঞ্চি আর তার সঙ্গীদের মুখে কোনও আগ্রহর চিহ্ন মাত্র নেই। জানতে পারলাম বলরামপুর শহরেই বাড়ি বিরিঞ্চির। ব্যাবসায়ী পরিবার। পরিবারের আর কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।

মাঠের ধুলো উড়িয়ে বিরিঞ্চির এনফিল্ড মোটর সাইকেল বেরিয়ে গেলেন।—নিজস্ব চিত্র।

আক্রমণাত্মক এই তরুণকে একটু বাউন্সার দেওয়ার জন্যই প্রশ্ন করলাম, “আপনাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, আপনারা ঝাড়খণ্ড থেকে লোকজন নিয়ে আসছেন।”

প্রশ্ন শুনে এবার হেসে ফেললেন বিরিঞ্চি, “ঝাড়খণ্ড কি ভারতের বাইরে। এখানে যে দিকেই তাকাবেন সেই দিকেই ঝাড়খণ্ড। আসে তো। ঝাড়খণ্ড থেকে আমাদের কার্যকর্তারা নিয়মিত আসে। ক’দিন আগেই তো এই মোদী ধর্মশালাতেই তাঁরা ছিলেন।”

এ বার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন বিরিঞ্চি। “জরুরি কাজ আছে দাদা”, বলে দরজার দিকে এগোতে এগোতেই হাত তুলে আবার বলে উঠলেন, “দাদা, একটা কথা লিখবেন। যা খুন হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আর কোনও বিজেপি কর্মী খুন হবে না। কী ভাবে রুখতে হয় সেটা এ বার আমরা করে দেখাব।”

মাঠের ধুলো উড়িয়ে বিরিঞ্চির এনফিল্ড মোটর সাইকেল বেরিয়ে গেলেন। পিছনে বাকিরা। বিজেপির মঞ্চ পাশ কাটিয়ে টাটার দিকে চলে গেল বাইক। রাস্তার মাইলস্টোনে লেখা জামশেদপুর সাতান্ন কিলোমিটার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE