Advertisement
০৪ মে ২০২৪

জাতীয় গড়ের নিরিখে সাফল্য দাবি মুখ্যমন্ত্রীর, উঠছে প্রশ্নও

তুলনা হতে পারত অন্য রাজ্যের সঙ্গে। সেই পথে না-হেঁটে এ বার জাতীয় গড়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং দাবি করলেন, মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে কৃষি, শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় হারকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে তাঁর সরকার।

উপহারের প্যাকেট হাতে আইপিএস অফিসারেরা। শুক্রবার টাউন হলের বাইরে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

উপহারের প্যাকেট হাতে আইপিএস অফিসারেরা। শুক্রবার টাউন হলের বাইরে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

তুলনা হতে পারত অন্য রাজ্যের সঙ্গে। সেই পথে না-হেঁটে এ বার জাতীয় গড়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং দাবি করলেন, মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে কৃষি, শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় হারকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে তাঁর সরকার।

শুক্রবার রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বিজয়া সম্মেলনে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টাউন হলের ওই অনুষ্ঠানের ফাঁকে তাঁর সরকার কত দ্রুত উন্নয়নের কাজ করছে, তার ফিরিস্তি দেন মমতা। সেখানেই তিনি ওই দাবি করেন। পরে সাংবাদিক বৈঠকেও এ কথা বলেন।

প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনীতির নিয়ম মেনে জাতীয় হারের সঙ্গে কি কোনও একটি রাজ্যের তুলনা হতে পারে? যেখানে দেশের কৃষি-শিল্প কিংবা পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি মাপতে গেলে উত্তর-পূর্বের কমজোরি রাজ্যগুলিও হিসেবের তালিকায় চলে আসে, সেখানে স্বাভাবিক বিচারেই দেশের গড় কম হতে বাধ্য। তা হলে কী ভাবে শুধু গড়ের নিরিখে গোটা দেশের সঙ্গে একটি রাজ্যের তুলনা সম্ভব?

আইআইএম (কলকাতা)-র অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহ মনে করেন, ‘‘জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি, এ দাবি করা যেতেই পারে। কিন্তু তাতে গোটা ছবিটা স্পষ্ট হয় না। ধারে-ভারে যে রাজ্যগুলো পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বৃদ্ধির হার দেখতে হবে।’’ তাঁর বক্তব্য: ধরা যাক, কোনও পরীক্ষায় ৫০ জন ছাত্র গড়ে ৫৫ নম্বর পেল। তারই মধ্যে এক জন পেল ৬৫। এ ক্ষেত্রে ওই ছাত্র গড়ের বেশি পেল ঠিকই, কিন্তু অন্যরাও একক ভাবে কত পেল, তা দেখতে হবে। তবেই সঠিক মূল্যায়ন হবে।

প্রায় একই সুরে বাম আমলের এক মন্ত্রীর দাবি, তাঁরা কখনওই কোনও বৃদ্ধির হার নির্ণয় করতে গিয়ে রাজ্যের সঙ্গে গোটা দেশের তুলনা টানতেন না। অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যের সঙ্গে তুলনামূলক মূল্যায়ন করতেন। কারণ, আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রের মিল রয়েছে। ‘‘যে ব্যাটসম্যান একশো বলে সেঞ্চুরি হাঁকান, তাঁর ‘স্ট্রাইক রেট ১০০। আবার যিনি এক বলে এক রান করেছেন, তাঁরও তা-ই। তা হলে কি শুধু গড় যাচাই করে ‘পারফরম্যান্স’ বোঝা যায়?’’— প্রশ্ন রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার।

এ প্রসঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মত পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। আইএসআইয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার বলেছেন, ‘‘রাজ্যের তুলনায় জাতীয় হার কখনও বেশি, কখনও কম— এটা হতেই পারে। যেমন ২০১১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের নীচে ছিল। ২০১২-১৩ সালের পরে তা বেড়েছে। আবার মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে এখনও এ রাজ্যের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। তবে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।’’ অভিরূপবাবুর দাবি, এই আমলে রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে যথেষ্ট বৃদ্ধি ঘটেছে। বৃদ্ধি ঘটেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে। যদিও ভারী শিল্পে তেমন আশানুরূপ বৃদ্ধি ঘটেনি বলে তিনি মনে করেন।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘জাতীয় স্তরে বৃদ্ধির হার যেখানে ৭%, সেখানে আমাদের ১০.৪৮%। একই ভাবে শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে। শিল্পে জাতীয় বৃদ্ধির হার ৮%, এ রাজ্যে ১০%। আর কৃষিতে জাতীয় বৃদ্ধির হার ১%, আমাদের ৬%।’’ মমতার দাবি, সম্পদবৃদ্ধির দৌড়েও পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হার। এ প্রসঙ্গেও জাতীয় হার তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ওরা ৬, আমরা ১২।’’

এই ‘সাফল্যের’ জন্য প্রশাসনের আধিকারিকদেরই পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শারদ উৎসবে ভাল ভাবে কাজের জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের। তার আগে জানিয়েছেন শুভেচ্ছা। বিজয়া সম্মেলন শুরু হয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় দুপুর একটায়। চলছে আধ ঘণ্টার কিছু বেশি।

সম্মেলনে মমতা বলেন, ‘‘এরই মধ্যে উন্নয়নের কাজ নিয়ে রিভিউ করেছি আমরা। সকলে খুব ভাল কাজ করছেন।’’ বিজয়া শেষে বাইরে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বর্ষার পরে আবার কাজ শুরু হয়েছে। অনেক দফতর পরিকল্পনা বাজেটের দেড়শো শতাংশ টাকা খরচ করে ফেলেছে।’’ গত বারের তুলনায় চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২৪% বেশি খরচ হয়েছে বলে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘কাজও বেশি হয়েছে।’’

এটা অবশ্য নতুন নয়। তাঁর সরকার ৯০% কাজ সেরে ফেলেছে— মমতার মুখে এমন দাবি আগেও শোনা গিয়েছে।

এ দিন দিল্লির দিকে অভিযোগের আঙুলও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘‘কেন্দ্র ৩৭টি প্রকল্প পুরো বন্ধ করে দিয়েছে। ৫০টির মতো প্রকল্প প্রায় বন্ধ করেছে, অথবা বরাদ্দ কমিয়েছে। আমরা রাজ্যের নিজস্ব বাজেট বরাদ্দ থেকে তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে সেগুলো চালাচ্ছি।’’— বলেন তিনি। সাম্প্রতিক বন্যায় কোনও সাহায্য না পাওয়ার জন্যও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। বলেছেন, ‘‘বন্যার পরে কেন্দ্রের দল ঘুরে গেল। এল আবার খরায়। কিন্তু এক টাকাও সাহায্য দিল না। এই টানাটানির মধ্যেও আমরা দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ দিয়েছি।’’

মমতা জানান, সব জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক হয়ে গিয়েছে। বাকি শুধু পূর্ব মেদিনীপুর। ডিসেম্বরে সেখানে যাবেন। আগামী দু’-তিন মাসের মধ্যে তাঁর সরকার যাতে সব কাজ শেষ করে ফেলতে পারে, আপাতত সেই চেষ্টাই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

success rate police mamata bandopadhay westbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE