Advertisement
E-Paper

ধুলো ঝড়ে মিলিয়ে যায় গরু

পাচার নিষিদ্ধ। ওঁরা জানেন। কিন্তু মানতে চান না। উল্টে দাবি করেন, এ তো ব্যবসা। সেই ‘ব্যবসা’য় লাভ আছে। জীবনের ঝুঁকি আছে আরও বেশি। তবুও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হয়নি। বরং বদলেছে তার কৌশল। বদলেছে পাচার সামগ্রী। ডোমকল ও করিমপুর: ঝোপ বুঝে যে কোপ মারতে পারে না, সে আবার কেমন ‘ইস্মাগলার’!সীমান্তে প্রবাদটা বেশ প্রচলিত। তাই তক্কে তক্কে থাকে পাচারকারীরা।

সুজাউদ্দিন ও কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০০:২১
আড়াল। উপরে কুয়াশা। নীচে, পাটখেত। — ফাইল চিত্র

আড়াল। উপরে কুয়াশা। নীচে, পাটখেত। — ফাইল চিত্র

ঝোপ বুঝে যে কোপ মারতে পারে না, সে আবার কেমন ‘ইস্মাগলার’!

সীমান্তে প্রবাদটা বেশ প্রচলিত। তাই তক্কে তক্কে থাকে পাচারকারীরা। ‘ফাঁদ পেতে’ সতর্ক থাকে বিএসএফও। কখনও সেই ‘ফাঁদ’ গলে দিব্যি বেরিয়ে যায় ‘ইস্মাগলার’। কখনও আবার চওড়া হয় বিএসএফের হাসি। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নজরদারি ও ঋতু পরিবর্তনের সৌজন্যে পাচারের রমরমা কখনও কমে, কখনও বাড়ে। কিন্তু সীমান্তের রাঙাচোখ উপেক্ষা করে পাচার কিন্তু চলতেই থাকে।

কালবৈশাখী

জল শুকিয়েছে পদ্মায়। হাঁটুজল মাথাভাঙাতেও স্নান করা দায়। চারপাশে ধু ধু বালির চর। চাঁদিফাটা রোদে পিচ গলছে বর্ডার রোডে। সূর্য পাটে যেতে ঢের দেরি। কিন্তু ওই দূরের মাঠে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে কারা? চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়েও স্বস্তি পাচ্ছেন না মাঝবয়সী বিএসএফ জওয়ান। গরুগুলো তো ‘বর্ডার’ পেরোচ্ছে না! যেখানে ঢুকছে সেটাও তো ভারতীয় গ্রাম। তবে?

হাসছেন রানিনগর সীমান্তের এক প্রৌঢ়, ‘‘ওইটাই তো মজা কর্তা। কাদের গরু, কাদের রাখাল, ঝড় উঠলেই সামাল সামাল!’’ মজা কীসের, এ তো আজব ধাঁধাঁ। ওই প্রৌঢ় ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আপনাদের ধাঁধাঁ মনে হচ্ছে। কিন্তু তামাম সীমান্ত জানে গরুগুলো যাবে বাংলাদেশে। এ তারই প্রস্তুতি। কিংবা অপেক্ষাও বলতে পারেন।’’ অপেক্ষা?

আজ্ঞে হ্যাঁ, অপেক্ষা। কালবৈশাখীর। গরু, গাঁজা, ফেনসিডিলের মতো নানা পাচার সামগ্রী আগে থেকেই মজুত করা হয় সীমান্ত লাগোয়া কোনও বাড়িতে। তারপর মওকা বুঝে সেগুলো চলে যাবে ওপারে। গ্রীষ্মকালে সেই মোক্ষম সুযোগটাই করে দেয় কালবৈশাখী। আকাশে ঘন মেঘ। প্রবল ধুলো ঝড়ে ঢেকে যায় চরাচর। ঠিক তখনই বালির উপর দিয়ে শুরু হয় দৌড়। ঝড় থামার আগেই ‘কাজ’ শেষ। ধুলো ঝড়ে ঢেকে যায় বালির উপরে পড়া মানুষ ও গরুর পায়ের ছাপ!

পায়ের ছাপ মিলিয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় বেশ কিছু দিন। সীমান্ত লাগোয়া বাড়িতে শুরু হয় বিএসএফের ছানবিন। রানিনগর, রানিতলা, নির্মলচর জানে সে যন্ত্রণার কথা। ওই এলাকার বাসিন্দা তথা রানিনগর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কংগ্রেসের আসরাফুজ্জামানের কথায়, ‘‘দেখুন, এ দেশের লোক জড়িত না থাকলে পাচার সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে গোটা গ্রাম পাচারের সঙ্গে যুক্ত, এটাও ঠিক নয়। কিন্তু বিএসএফ কোনও বাছবিচার করে না। ফলে হয়রান হতে হয়
তামাম গ্রামকেই।’’

বর্ষার পাট

একদিকে দু’মুঠো ভাত। অন্য দিকে দেশের নিরাপত্তা। ফি বর্ষার আগে বিএসএফ ও সীমান্তের চাষিদের এই নিয়ে একবার করে গোল বাধে। বিষয়— সীমান্তে পাট চাষ। বিএসএফের দাবি, কাঁটাতারের ওপারে ভারতীয় জমিতে পাট লাগালে নজরদারির সমস্যা হয়। যার সুযোগ নেয় পাচারকারীরা। আর চাষিদের পাল্টা দাবি, পাটের মতো অর্থকরী ফসল চাষ বন্ধ করলে না খেতে পেয়ে মরতে হবে।

করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএমের প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল বলছেন, ‘‘বিএসএফের কথাতে যুক্তি আছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়টিও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু পাট বাদে চাষিদের জন্য বিকল্প অর্থকরী চাষের ব্যবস্থা করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু তা করছে কে!’’

বিএসএফের ক্ষোভ, এক বর্ষায় রক্ষা নেই, দোসর পাটগাছ। এই পাটগাছই যত নষ্টের মূলে। পাটখেতের আড়ালে তাদের নজর এড়িয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় সীমান্তের ওপারে।

নদিয়া সীমান্তের বিএসএফের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘আমরা চাষিদের কোনও ক্ষতি চাই না। কিন্তু সীমান্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার বিষয়টিও। পাটের পরিবর্তে সীমান্ত এলাকায় বিকল্প কোনও চাষে প্রশাসন যদি চাষিদের উৎসাহিত করত তাহলে পাচারে রাশ টানা যেত।’’

পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা বদর আলি কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, ‘‘পাটের মরসুম এলেই এই এলাকায় পাচারকারীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। দিনরাত মোটরবাইক নিয়ে চরকি পাক দেয় অচেনা মুখ। মাঠে যতদিন পাট থাকবে ততদিন এই দাপট চলবে।’’ আর এক চাষির কথায়, ‘‘পাটের লাভ তো পাচারকারীরাই খেয়ে নেয়। গরু আর মানুষের পায়ের চাপে বহু পাট নষ্ট হয়। কার কাছে অভিযোগ জানাব বলুন?’’ বিএএফের দাবি, এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে এখন পাচারকারীরাও বহু চাষিকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে।

শীতের কুয়াশা

পাচারকারীদের পৌষমাস, বিএসএফের সর্বনাশ! কথাটা বোধহয় খুব ভুল নয়। ধুলোঝড়, বৃষ্টি, পাটখেতের থেকেও বড় আড়াল জমাট কুয়াশা। গাছের পাতা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে শিশির। পূব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। নরম লেপের ওমে এপাশ ওপাশ। এটা যদি আমবাঙালির শীত-সকাল হয়, তাহলে বিএসএফের সাতসকাল ঠিক উল্টো। কারণ এই সময়টাই সবথেকে বেশি সতর্ক থাকতে হয় জওয়ানদের। বর্ডার রোডের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটার চাদরের ভিতরে অন্য কিছু নেই তো? সদ্য যুবকের জ্যাকেটটা কি বেঢপ মোটা দেখাচ্ছে? সন্দেহ। প্রশ্নবাণ। কখনও কখনও সত্যি হয়ে যায় সন্দেহ। মিলে যায় গাঁজা কিংবা ফেনসিডিলের বোতল। বিএসএফের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ঘন কুয়াশায় বাইনোকুলার খুব কাজে দেয় না। কুয়াশার আড়ালকে কাজে লাগিয়ে শীতে পাচার বেড়ে যায়। আমরাও সতর্ক থাকি। কিন্তু কুয়াশার সঙ্গে যুঝতে না পারলে এই সময়টাই পাচার রোখা বেশ কঠিন।’’

কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। সীমান্তের এক পাচারকারীও কবুল করছে, ‘‘গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার থেকে শীতটাই আমাদের কাছে সবথেকে সুবিধার। কুয়াশাটা একটা বড় কারণ। তাছাড়া ঠান্ডার কারণে গরু কিংবা অন্য পাচার সামগ্রী নিয়ে হাঁটতেও আমাদের অসুবিধা হয় না।’’

কী কাণ্ড!

Trafficing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy