Advertisement
E-Paper

বিমানের অবতরণ, সিপিএমে সূর্যোদয়

রাজনীতির গুরুদায়িত্ব কাঁধে চাপার আগে ১ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখতেন। বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াতেন গ্রাম থেকে গ্রাম। ডাক্তারি ছেড়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে ঢুকে যাওয়ার পরেও এক বার দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন আলিমুদ্দিনে! মেঝেতে শুইয়ে বুকে ‘কার্ডিয়াক মাসাজ’ করে সে যাত্রা দলীয় সতীর্থের ত্রাতার ভূমিকায় তাঁকে দেখেছিল আলিমুদ্দিন।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪০

রাজনীতির গুরুদায়িত্ব কাঁধে চাপার আগে ১ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখতেন। বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াতেন গ্রাম থেকে গ্রাম। ডাক্তারি ছেড়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে ঢুকে যাওয়ার পরেও এক বার দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন আলিমুদ্দিনে! মেঝেতে শুইয়ে বুকে ‘কার্ডিয়াক মাসাজ’ করে সে যাত্রা দলীয় সতীর্থের ত্রাতার ভূমিকায় তাঁকে দেখেছিল আলিমুদ্দিন।

এ বার পরিস্থিতির চাপে কোণঠাসা গোটা দলই পরিত্রাণ খুঁজছে। প্রবল সঙ্কটের সময়ে শেষ পর্যন্ত সূর্যকান্ত মিশ্রের হাতেই দলের দায়িত্ব তুলে দিল সিপিএম। মনে গভীর আশা, চিকিৎসক-নেতা সূর্যবাবুই যদি রোগমুক্তির দাওয়াই খুঁজে দিতে পারেন! পরের পর নির্বাচনে ভোটবাক্সে অবিরত রক্তক্ষরণ, সংগঠনে অবিশ্রান্ত ভাঙন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে মুখ বদলানোই ছিল সিপিএমের অন্তিম তাস। রাজ্যে পরবর্তী বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে দলের ২৪তম রাজ্য সম্মেলন থেকে মরিয়া সিপিএম সেই তাসটাই খেলে দিল শুক্রবার। বিমান বসুর পরিবর্তে দলের রাজ্য সম্পাদক হিসাবে অভিষেক হল সূর্যবাবুর।

কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এবং পৃথক সিপিএম তৈরি হওয়ার পরে এই প্রথম বার দলের রাজ্য সম্পাদক এবং বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হল একই ব্যক্তিকে। এর আগে এ ভাবে যুগ্ম দায়িত্ব পালন করেছিলেন জ্যোতি বসু। তবে তখনকার চেয়ে সূর্যবাবুর সময়ের পরিস্থিতি অনেক আলাদা এবং জটিল। শেষ পর্যন্ত সূর্যবাবুই বিরোধী দলনেতার পদে থেকে যাবেন কি না, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে নেবে আলিমুদ্দিন। আপাতত তাদের লক্ষ্য, নতুন রাজ্য সম্পাদকের নেতৃত্বে তৃণমূল এবং বিজেপি-র মোকাবিলায় দলটাকে রাস্তায় নামিয়ে আন্দোলনের পথে রাখা। সামনে পুরভোট এবং পরে বিধানসভা ভোটে সম্মানজনক লড়াই দেওয়া। এবং সর্বোপরি সংগঠনের আব্রু ফেরানো! ‘তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও এবং বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও’ নতুন সম্পাদক নির্বাচনের পাশাপাশি এ দিন এই মর্মে প্রস্তাবও নেওয়া হয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে।

সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বও জানেন, রাজ্য সম্পাদক পদে মুখ বদল হওয়া মানেই আসন্ন পুরভোট থেকে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনা নয়। আসল লড়াই সংগঠনকে লড়াইয়ের উপযুক্ত করে তোলা। যে কারণে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকেই নজর দিতে চাইছেন সূর্যবাবু। আর বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুও এই সম্মেলনে বলে দিয়েছেন, কোনও ডন কিহোতে বা হারকিউলিস এসে রাতারাতি দলের উন্নতি ঘটিয়ে দেবেন না! তার জন্য সংগঠন দরকার। প্রবীণ-নবীনের সমন্বয় দরকার। আরও বেশি দরকার, নতুন সময় এবং নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে মনোভাব বদলানোর।


সিপিএমের নব নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। সঙ্গে বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু।
শুক্রবার সিপিএমের ২৪তম রাজ্য সম্মেলনে পরে সাংবাদিক বৈঠকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

রাজ্য সম্মেলনের শেষ ও পঞ্চম দিনে নতুন রাজ্য সম্পাদক হিসাবে প্রথা মেনে ৬৬ বছরের সূর্যবাবুর নাম প্রস্তাব করেন ৭৫ বছরের বিমানবাবুই। পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির সভাপতিত্বে নবগঠিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে নতুন রাজ্য সম্পাদকের নাম সমর্থন করেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিমানবাবুই আপাতত বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান থাকছেন। ঠিক যেমন শৈলেন দাশগুপ্তের জায়গায় অনিল বিশ্বাস সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে শৈলেনবাবুই ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। পদ ছাড়ার পরে বিমানবাবু সম্মিলিত দায়িত্বে কাজ করার কথাই বলেছেন।

সিপিএমের অন্দরের সমীকরণে এক সময়ে সূর্যবাবুর পরিচিতি ছিল ‘বিমানবাবুর লোক’ হিসাবেই। সাম্প্রতিক কালে নিজের পারফরম্যান্সের জোরেই অবশ্য বুদ্ধবাবুর আস্থা অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। স্বভাবে অবশ্য বিদায়ী এবং নতুন রাজ্য সম্পাদকের ফারাক বিস্তার। বিমানবাবু যতটা প্রগলভ, সূর্যবাবু ততটাই মিতবাক! সিদ্ধান্ত নিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামে বিমানবাবু যতটা দীর্ঘসূত্রী, সূর্যবাবু ততটাই দ্রুতগামী! প্রথমে অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি এবং পরে ভূমি, পঞ্চায়েত ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে যে শুষ্কং কাষ্ঠং সূর্যবাবুকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন অনেকে, বিরোধী দলনেতা হিসাবে তার চেয়ে ঢের খোলামেলা ও উদার ভূমিকায় নিজেকে পেশ করার ‘পরিবর্তন’ ইতিমধ্যে সেরে নিয়েছেন সূর্যবাবু। বিরোধী দলনেতা হিসাবে গত চার বছরে রাজ্যের সর্বত্র আক্রান্ত মানুষের পাশে ছুটে গিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের আস্থাও অনেকটা অর্জন করতে পেরেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের বিধায়ক।

নতুন দায়িত্ব পেয়েও আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তাই দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। সূর্যবাবুর কথায়, “আমাদের দলে নতুন পদে নির্বাচিত হওয়া মানে আনন্দের কোনও ব্যাপার নয়! এটা দায়িত্বের বিষয়। যে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ আক্রান্ত, তাঁদের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের দলের আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের জন্য এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রতি আমি দায়বদ্ধ। তাঁদের জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও দায়িত্ব পালন করব!” তাঁর সামনে পরিস্থিতি তো খুবই কঠিন? সূর্যবাবুর বক্তব্য, “পরিস্থিতি সব সময়েই কঠিন থাকে। আমার পূর্বসূরিরা আরও অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামলেছেন। তাঁরা কেউ সাতের দশকের আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছেন, কেউ আবার স্বাধীনতার পরে তিল তিল করে এই পার্টিটাকে গড়ে তুলেছেন। সেই তুলনায় আমি নগণ্য ব্যক্তি!”

এই ‘নগণ্য ব্যক্তি’র পরিবারই অবশ্য আপাতত সংবাদের শিরোনামে! তাঁর স্ত্রীর পরিচালনাধীন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগে রাজ্য প্রশাসনের তদন্ত এবং অভিযান চলছে। সাম্প্রতিক অতীতে তাঁর শিক্ষিকা-কন্যাকে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। তাঁর ভাইয়ের অবসরকালীন পাওনাও আটকানোর চেষ্টা হয়েছে নানা অভিযোগ দেখিয়ে। এ সবই কি তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে হেনস্থা করার জন্য? রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে সূর্যবাবু অবশ্য স্ত্রীর সংস্থায় তদন্ত নিয়ে এই সংক্রান্ত অভিযোগকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি। বরং, দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিজের পরিবারকে এক করেই দেখাতে চেয়েছেন। বলেছেন, “আমাদের এক লক্ষাধিক কর্মী-সমর্থকের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে। অনেকে ঘরছাড়া। অনেকে আক্রমণে পঙ্গু। যাঁরা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের কথা না হয় বাদই রাখলাম। তার তুলনায় এটা কিছুই না! এ নিয়ে বেশি কথায় যেতে চাই না!”

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ যাদের দিকে, সেই শাসক দলের নেতৃত্বও সিপিএমের মুখ বদলকে গুরুত্ব দিতে চাননি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সূর্য নিজেই তো পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। নতুন কোনও ঘুঁটি তো নেই! পুরনো মুখই দেখছি। একই সঙ্গে বিরোধী দলনেতা এবং দলের রাজ্য সম্পাদক হওয়া যায়, এ-ও দেখলাম!” সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য পাল্টা বলছেন, পার্থবাবুও একসঙ্গে দলের মহাসচিব এবং বিরোধী দলনেতা এবং এখন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। মুকুল রায়ের জায়গায় তৃণমূলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন যিনি, সেই সুব্রত বক্সীও কি ‘নতুন ঘুঁটি’?


নব্বইয়ের দশকে এক দলীয় কর্মসূচিতে সূর্যকান্ত মিশ্র (মাঝে), বিমান বসু (ডান দিকে)
ও নারায়ণগড়ের প্রবীণ সিপিএম নেতা অনিল পাত্র (বাঁ দিকে)।—ফাইল চিত্র।

শাসক-বিরোধী চাপানউতোর যা-ই থাকুক, সিপিএমের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই সম্পাদক বদলে খুশি। দলের এক তরুণ নেতার কথায়, “অনেক দিন পরে এক জন সম্পাদক পাওয়া গেল, যাঁকে মোবাইলে পাওয়া যায়! মেসেজ করা যায়, মেল করা যায়। সিদ্ধান্ত জানতে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না।” প্রথম জীবনে ডাক্তারি এবং পরে বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণও নেওয়া আছে সূর্যবাবুর। ঘনিষ্ঠ মহলে বলে থাকেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ হলে দেশের জন্য বন্দুক হাতে নেমে পড়তেও পারেন! আপাতত ‘আক্রান্ত’ দলের জন্য তাঁর গোলা-‘বর্ষণে’র অপেক্ষাতেই আছে আলিমুদ্দিন! গর্জন তো অনেক হল!

cpm state committee sandipan chakrabarty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy