Advertisement
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

সালিশি সভার পরে আত্মঘাতী শিক্ষক, অভিযুক্ত সেই তৃণমূল

আবার সালিশি। আবার মানসিক চাপ সৃষ্টির অভিযোগ। আবারও মৃত্যু। এবং আবারও নাম জড়াল শাসক দলের। এ বার মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি। গ্রাম, ডাঙাপাড়া। রবিবার ভোরে গ্রামের বাড়িতেই পাওয়া যায় প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক দিলীপ মণ্ডলের নিথর দেহ। সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, দিলীপবাবু মৃত। প্রাথমিক ভাবে, পুলিশের অনুমান কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন দিলীপবাবু।

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২০
Share: Save:

আবার সালিশি। আবার মানসিক চাপ সৃষ্টির অভিযোগ। আবারও মৃত্যু।

এবং আবারও নাম জড়াল শাসক দলের।

এ বার মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি। গ্রাম, ডাঙাপাড়া।

রবিবার ভোরে গ্রামের বাড়িতেই পাওয়া যায় প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক দিলীপ মণ্ডলের নিথর দেহ। সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, দিলীপবাবু মৃত। প্রাথমিক ভাবে, পুলিশের অনুমান কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন দিলীপবাবু। ৩৫ বছরের ওই শিক্ষকের ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গিয়েছে। সেখানে তিনি তাঁর মৃত্যুর জন্য রামকৃষ্ণ মার্জিত নামে এক তৃণমূল কর্মীকে দায়ী করে গিয়েছেন।

এই রামকৃষ্ণ মার্জিতের নামের সূত্র ধরেই উঠে আসছে সালিশি সভার ঘটনা। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, গ্রামেরই এর মহিলাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল দিলীপবাবুর বিরুদ্ধে। তারই ‘বিচার’ করতে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার, গ্রামে বসেছিল সালিশি সভা। সেখানে স্থানীয় তৃণমূল নেতা অশোক মার্জিত, তৃণমূল কর্মী রামকৃষ্ণ মার্জিত-সহ শাসক দলের অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সভায় দিলীপকে দোষী সাব্যস্ত করে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। তাঁকে নানা ভাবে অপমান করা হয় বলেও অভিযোগ। এই ঘটনার জেরেই দিলীপবাবু আত্মঘাতী হয়েছেন বলে তাঁর পরিবারের দাবি।

মৃত দিলীপবাবুর স্ত্রী বছর চারেক আগে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাঁর বছর ছয়েকের মেয়ে থাকে দাদুর কাছে। ডাঙাপাড়ায় ওই শিক্ষকের সঙ্গে থাকতেন তাঁর ৭৫ বছরের মা পানুদেবী। তাঁরও দাবি, “আমার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে। বদনাম সহ্য করতে না পেরেই দিলীপ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।”

মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর জানান, সালিশি সভা বসিয়ে ওই শিক্ষককে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। সুইসাইড নোটে নাম থাকা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাগরদিঘি থানাকে। এসপি বলেন, “কান টানলেই মাথা আসবে! যারা সালিশি সভা বসিয়েছিল, তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।”

মূল অভিযুক্ত রামকৃষ্ণ মার্জিত গা ঢাকা দিলেও সালিশি সভা বসানোর কথা কিন্তু মেনে নিয়েছেন তৃণমূল নেতা অশোক মার্জিত। তাঁর দাবি, দিলীপবাবু প্রতিবেশী এক মহিলাকে নিগ্রহ করেছেন বলে অভিযোগ এসেছিল। ওই মহিলার পরিবার গ্রামে বিচারের আবেদন করেন। অশোকবাবুর কথায়, থানা-পুলিশের ‘ঝামেলা’ এড়াতে দিলীপবাবুও তাতে রাজি হন। উভয় পক্ষের সম্মতিতেই দিলীপবাবুর দাদার শ্বশুর মদন মণ্ডলের বাড়িতে সালিশি সভা বসে। অশোকবাবু বলেন, “সেখানে উভয় পক্ষের সম্মতি নিয়েই এক লক্ষ টাকা দিতে বলা হয় শিক্ষককে।” ৫০ হাজার টাকা তিন মাসের মধ্যে ওই মহিলাকে দিতে বলা হয়। বাকি ৫০ হাজার টাকা গ্রামের দু’টি পাড়ার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে একটি সালিশি-নামায় সইও করানো হয় তাঁদের। তবে অশোকবাবু দাবি করছেন, “এখন আমার কাছে ওই চুক্তিপত্র আর নেই। ছিঁড়ে ফেলেছি!”

উভয় পক্ষের সম্মতিতেই যে সালিশি সভা বসেছিল, সেটা অস্বীকার করছেন না দিলীপবাবুর দাদা সুকুমার মণ্ডলও। তাঁর কথায়, “পুলিশের কাছে গেলে বদনাম আরও বাড়বে ভেবেই সালিশি সভায় রাজি হয়েছিলাম আমরা।” এমনকী দিলীপবাবু তাঁর সুইসাইড নোটেও লিখে গিয়েছেন, সালিশি সভা তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। তাঁর অভিযোগের আঙুল শুধু রামকৃষ্ণ মার্জিতের দিকেই। কেন? সুকুমারবাবু বলেন, “গোটা ঘটনাতে রামকৃষ্ণ অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল। সালিশি সভা বসাতে উস্কানি দেওয়া থেকে শুরু করে পদে পদে অপমান করেছিল রামকৃষ্ণই। ভাই আমাদের কাছে বারবার বলেছে, ‘রামকৃষ্ণটাই আমাকে শেষ করে দিল’।”


আত্মঘাতী শিক্ষক দিলীপ মণ্ডলের ‘সুইসাইড নোট’।

তবে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনীতিকদের একাংশ, সকলেই বলছেন সালিশি-সংস্কৃতিই বিপদের মূল। পুলিশ প্রশাসনকে এড়িয়ে এই সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জাঁকিয়ে বসছে রাজনৈতিক খবরদারি। বাম যুগ থেকে বর্তমান জমানা সর্বত্রই ছবিটা এক। গ্রামবাংলার অনেকের মুখেই আক্ষেপ, “পালাবদলের পরে রাজনৈতিক ব্যাটনটাই যা বদলেছে। পাল্টায়নি আর কিছুই।”

ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিবাদে নাক গলানোটা একটা সময় দস্তুর ছিল সিপিএমের আমলে। ব্যবসায়ীর সঙ্গে ক্রেতার বচসা থেকে শুরু করে দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া যে কোনও বিষয়েই মেজো-সেজো নেতারা পার্টি অফিসে ডেকে পাঠাতেন দু’পক্ষকে, নতুবা এলাকায় বসানো হত মীমাংসা সভা। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা-কেশপুর থেকে শুরু করে হুগলির আরামবাগ-গোঘাট বা বর্ধমানের রায়না-মেমারি-মঙ্গলকোট পার্টিই ছিল দণ্ডদাতা। এখন ঠিক একই ভাবে খেজুরি থেকে ধূপগুড়ি বা ধনেখালি, পরের পর এলাকায় সালিশি সভায় নাম জড়াচ্ছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা, কর্মী বা পঞ্চায়েত সদস্যের। হালের টাটকা উদাহরণ আরামবাগের তিরোল। সেখানে জমি নিয়ে মা-ছেলের বিবাদে নাক গলিয়েছিলেন পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা ঝর্না সিংহ। ধূপগুড়িতে সামান্য পাওয়ার টিলার ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে বিবাদের জেরে সালিশি সভা বসেছিল। সেখানে বাবাকে জরিমানা করায় প্রতিবাদ করেছিল দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। পরের দিন ওই ছাত্রীর দেহ মেলে রেল লাইনের ধারে। হুগলির গুড়াপের সালিশি সভায় এক প্রৌঢ়কে শাবলের বাড়ি মারা ও পরে তাঁর মৃত্যুতেও জড়ায় শাসক দলের নাম।

সাগরদিঘির ডাঙাপাড়া গ্রামেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন। গ্রামের বাসিন্দা অন্যজয় মার্জিত বলেন, “অশোক মার্জিত ছিলেন সালিশির মধ্যমণি। সেখানে রামকৃষ্ণ মার্জিত-সহ তৃণমূলের লোকই বেশি ছিল। গ্রামের সাধারণ লোককে ডাকাই হয়নি।” স্থানীয় বোখরা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সিপিএমের অরুণ দাস বলেন, “পঞ্চায়েতের সদস্য হিসাবে আমাকেও ডাকা হয়েছিল। আমি সভায় গিয়ে সালিশির তীব্র প্রতিবাদ করি। ওই মহিলার পরিবারকে বলি, অভিযোগ থাকলে থানায় যেতে। কিন্তু ওরা কেউ কথা না শোনায় আমি চলে এসেছিলাম।”

পুলিশ সুপার নিজে বলছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, “এটাকে কোনও ভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। সালিশি যাতে না হয়, সে বিষয়ে পুলিশকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে।” কিন্তু প্রতি পদে সালিশি সভার নানা ঘটনায় যে ভাবে শাসক দলের নাম জড়াচ্ছে, তাতে দল কী ভাবছে? প্রশ্ন করা হলে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব মন্তব্য করতে চাননি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী নিজে মুর্শিদাবাদের সাংসদ। ঘটনাটি শুনে তাঁর মন্তব্য, “পুলিশ-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা সব কিছুরই সমান্তরাল ব্যবস্থা কায়েম করে ফেলেছে তৃণমূল। নৈরাজ্যের চূড়া অতিক্রম করেছে তারা।”

অন্য বিষয়গুলি:

settlement meeting biman hazra dangapara dilip mondal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy