Advertisement
E-Paper

পুরস্কারের টাকায় স্কুলে তারা ফোটাবেন তিনি

তারা চিনতে শিখবে বাচ্চারা। ছায়াপথকে জানবে। বুঝবে সৌরমণ্ডল, গ্রহ-গ্রহান্তরের বিস্তার। এমনই ইচ্ছে থেকে ক্লাসঘরের মধ্যেই পড়ুয়াদের রাতের আকাশ দেখানোর পরিকল্পনা করেছেন এক প্রধান শিক্ষক। স্কুলের ছাদে তারা ফোটানোর জন্য খরচ করছেন চলতি বছরেই পাওয়া সরকারি ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারের টাকা।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:১৩
কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়াদের নিয়ে খেলায় মেতেছেন পার্থবাবু। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়াদের নিয়ে খেলায় মেতেছেন পার্থবাবু। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

তারা চিনতে শিখবে বাচ্চারা। ছায়াপথকে জানবে। বুঝবে সৌরমণ্ডল, গ্রহ-গ্রহান্তরের বিস্তার। এমনই ইচ্ছে থেকে ক্লাসঘরের মধ্যেই পড়ুয়াদের রাতের আকাশ দেখানোর পরিকল্পনা করেছেন এক প্রধান শিক্ষক। স্কুলের ছাদে তারা ফোটানোর জন্য খরচ করছেন চলতি বছরেই পাওয়া সরকারি ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারের টাকা।

তিনি পার্থপ্রদীপ সিংহ। বীরভূমের লাভপুরে কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০০৯ সালে এই স্কুলে আসার পর থেকে তাঁকে স্কুল নিয়েই মেতে থাকতে দেখছেন এলাকাবাসী। লাভপুর শম্ভুনাথ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক বছর বাহান্নর এই মানুষটির মন জুড়ে রয়েছে স্কুল।

আদিবাসী অধ্যুষিত কালিকাপুরডাঙা গ্রামের এই স্কুল আগে জেলার আর পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে আলাদা ছিল না। কিন্তু অভিভাবকদের একটা বড় অংশ বলছেন, ‘‘হেডস্যার ভোল বদলে দিয়েছেন স্কুলের।’’ সম্পূর্ণ একমত লাভপুর চক্রের অবর স্কুল পরিদর্শক মোল্লা সরিফুল ইসলামও। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘‘পার্থবাবুর কর্মকাণ্ডের জন্য স্কুলটা শুধু ব্লকে নয়, জেলাতেও রোল মডেল হতে পারে।’’ এর আগে দুবসা প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন পার্থবাবু। তাঁর নেতৃত্বে সেই স্কুলেও পরিকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছিল। কালিকাপুরডাঙা স্কুলও যেন মনের মতো করে সাজাচ্ছেন তিনি।

গ্রামে ঢোকার রাস্তার এক দিকে পাঁচিল ঘেরা দোতলা স্কুলবাড়ি। অন্য পাশে মিড-ডে মিল রান্নাখাওয়ার জায়গা, শৌচাগার, ফুলবাগান ও খেলার জায়গা। প্রতি ক্লাসঘরে জলের আলাদা ফিল্টার। পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে প্রতি পড়ুয়ার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে থালা-বাটি-গ্লাস। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য রয়েছে তিনটি উচ্চতার বেসিন। বেসিনে ব্যবহৃত জল পাইপের মাধ্যমে গিয়ে পড়ে লাগোয়া ফুলবাগানে। রয়েছে ছেলে ও মেয়েদের তিনটি করে শৌচাগার। খেলার জন্যে আছে স্লিপ, দোলনা। মানুষের ক্রমবিবর্তন কী করে হল, রয়েছে তার মডেল-মূর্তি। প্রত্যন্ত এলাকার স্কুল হলেও রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা সংস্কৃতি-মঞ্চ। তথ্যচিত্র এবং সিনেমা দেখানোর জন্য রয়েছে প্রোজেক্টর। বাচ্চাদের আঁকা ছবির গ্যালারিও হয়েছে পার্থবাবুর আমলে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পার্থবাবুর তদারকিতেই গত ক’বছরে স্কুলটা সেজে উঠেছে।

প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৮৯। বছর সাতেক আগে দৈনিক গড় হাজিরা ছিল ৫০ শতাংশ। এখন তা হয়েছে ৯৫ শতাংশ। তপন কিস্কু, ফুলমণি কিস্কুরা বলছে, ‘‘স্কুল কামাই করতে ইচ্ছে করে না। শুধু পড়াশোনা নয়, খেলাধুলো, গল্প, খাওয়া-দাওয়া— কত মজা হয় স্কুলে। এক দিন কামাই করে পর দিন স্কুলে এলেই হেড স্যার জানতে চান, আগের দিন আসিনি কেন?’’

অভিভাবক লক্ষ্মী মুর্মু, মঙ্গলা হাঁসদারা জানাচ্ছেন, স্কুলের পরে দেখা হলেই বাচ্চাদের পড়াশোনা, শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেন পার্থবাবু। স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা বীথিকা মণ্ডল, শ্যামলী আচার্যেরা মানছেন, ‘‘স্যার এমন পরিবেশ তৈরি করেছেন যে, স্কুলে আসতে বাচ্চাদের তো বটেই, আমাদেরও ভাল লাগে।’’

শুধু তাই নয়। গ্রামবাসী-পড়ুয়া-অভিভাবক-স্কুলের অন্য শিক্ষকদের যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে, পার্থবাবু প্রাথমিক পরিকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি স্কুলকে কী করে আরও আকর্ষণীয়, আরও আধুনিক করে তোলা যায়, সে দিকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। নইলে ক’জন আর স্কুলে প্রোজেক্টর কেনার কথা ভাবেন! সেই প্রোজেক্টরই এ বার ‘তারামণ্ডল’ দেখানোর কাজেও লাগবে!

কী রকম? আপাতত স্কুলের দোতলার ছাদে ৩ ফুট x ৩ ফুট মাপের এলইডি প্যানেল বসানোর জায়গা করা হয়েছে। পরিকল্পনাটা হল— আর্ট গ্যালারির দরজা-জানলা বন্ধ করে আলো-আঁধারি করা হবে। সেখানে প্যানেলের উপরে দেখানো হবে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, শুকতারা, ছায়াপথ। প্রধান শিক্ষক বলছেন, ‘‘পরিকল্পনা শুনেই ছাত্রছাত্রীরা লাফাচ্ছে। দিনদুপুরে রাতের আকাশ চাক্ষুষ করলে ওরা না জানি কী করবে!’’ হঠাৎ এমন ভাবনা মাথায় এল কেন? পার্থবাবুর কথায়, ‘‘ছোটবেলায় রাতের আকাশে তারা চিনতে শিখিয়েছিলেন আমার বাবা। রাতে পড়তে ভাল না লাগলে আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে তারা চিনিয়ে ভুলিয়ে রাখতেন। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, আমিও ছাত্রছাত্রীদের রাতের আকাশে গ্রহ-নক্ষত্র দেখাব।’’ আগে অর্থাভাবে ইলেকট্রনিক বোর্ড বসানোর কাজ করতে পারেননি। এ বার তা শুরু হবে।

পুরস্কারের টাকা এ ভাবে খরচ করায় স্বামীর উপরে রাগ হয়নি? পার্থবাবুর স্ত্রী নীলিদেবী মুচকি হেসে বললেন, ‘‘গাঁটের কড়ি খরচ করে নাটকের দল আর একটা আবৃত্তি ও নাটক শেখার স্কুল চালান। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য যে এ রকম করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।’’

reward school teacher
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy