Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Jaynagar TMC Leader Murder

সিপিএমের নয়, জয়নগরে তৃণমূল নেতা খুনে অভিযুক্ত দলেরই কর্মী! দাবি করলেন নিহত সেই সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী

সন্ধ্যার পর বারুইপুরের এসডিপিও-র নেতৃত্বে দোলুয়াখাঁকি গ্রামে টহলদারি শুরু করে পুলিশ। প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে।

The man who beaten to death after Joynagar TMC Leader Saifuddin Laskar has been killed also claimed TMC

(বাঁ দিকে) সইফুদ্দিন লস্করের খুনের ঘটনায় উত্তপ্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর। —নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
জয়নগর শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৪২
Share: Save:

তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্করের খুনের ঘটনায় উত্তপ্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের বামনগাছি পঞ্চায়েত এলাকা। পাশাপাশি, খুনের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরা ফেলারও অভিযোগ উঠেছে সেখানে। ‘গণরোষে’ খুন হওয়া সেই সাহাবুদ্দিন শেখও তৃণমূল করতেন। এমনই দাবি করলেন মৃতের স্ত্রী। তিনি জানান, তাঁরা জয়নগর থানারই বাসিন্দা। তাঁর স্বামী শাসকদলের কর্মী ছিলেন। ওই মহিলার অভিযোগ, সোমবার সকালে তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন খুন হয়েছেন জানতে পেরে তাঁর বাড়িতে হানা দেন কয়েক জন লোক। প্রথমে তাঁর স্বামীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই খুনের নেপথ্যে কারা আছে। কিন্তু জবাবের অপেক্ষা না করে তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়। ওই মহিলার অভিযোগ, বাড়ির সামনেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাঁর স্বামীকে।

অন্য দিকে, ‘গণরোষে’ মৃত সম্পর্ক পুলিশের কাছে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন থানায় সাহাবুদ্দিনের নামে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাঁর নামে ‘ক্রিমিনাল রেকর্ড’ ছিল বলেও জানিয়েছে পুলিশ। গোটা ঘটনায় নতুন করে চাপানউতর শুরু হয়েছে।

সোমবার ভোরে জয়নগরের তৃণমূল নেতা তথা বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য এবং অঞ্চল প্রধান সইফুদ্দিন লস্করকে খুন করা হয়। নমাজ পড়তে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পুলিশ জানায়, মোট চার জন দুষ্কৃতী তাঁকে খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন। দুষ্কৃতীদের ছোড়া একটি গুলি সইফুদ্দিনের কাঁধে লাগে। স্থানীয়েরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। এই ঘটনার পরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব এই খুনের জন্য সিপিএমের দিকে আঙুল তোলেন। অন্য দিকে অভিযোগ ওঠে, শাসকদলের নেতা, কর্মী এবং বিক্ষুব্ধ কয়েক জন বামনগাছির সিপিএম প্রভাবিত দোলুয়াখাঁকি নস্কর পাড়া এলাকায় চড়াও হন। বেশ কয়েক জন সিপিএম কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কিছু বাড়ি। ওই এলাকা ছেড়ে আতঙ্কে পালিয়ে যান পরিবারের পুরুষ সদস্যেরা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটা সময় লেগে যায় পুলিশের। তারই মধ্যে তৃণমূল সমর্থকদের কয়েক জন প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন, এক ‘দুষ্কৃতী’কে তাঁরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। আর এক জন তাঁদের মার খেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা পলাতক। পুলিশ জানায়, শাহরুল শেখ নামে বছর তেইশের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেরায় ওই অভিযুক্ত স্বীকার করেছেন অপরাধের কথা। এ-ও জানা গিয়েছে যে, অভিযুক্তের বাড়ি উস্তি থানা এলাকার নেত্রা গ্রামে।

রাতের পরিস্থিতি

বিকেলের পর থেকে অবশ্য এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে পুলিশ। সন্ধ্যার পর বারুইপুরের এসডিপিও-র নেতৃত্বে দোলুয়াখাঁকি গ্রামে টহলদারি শুরু করেছে পুলিশ বাহিনী। নতুন করে যাতে উত্তেজনা না ছড়ায় সেদিকে নজর রেখেছে পুলিশ।

রাজনৈতিক উত্তেজনা

বস্তুত, বামনগাছি পঞ্চায়েতের দোলুয়াখাঁকি নস্কর পাড়া এলাকাটি সিপিএম প্রভাবিত। মঙ্গলবার ওই গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়দের মতো নেতাদের। যদিও সিপিএম নেতৃত্ব জানিয়েছেন, দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পুড়ে যাওয়া ঘর-বাড়িতে তাঁরা যেতে পারবেন কি না, প্রশাসন অনুমতি দেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কে এই সইফুদ্দিন

জয়নগরের মহিষমারিতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সইফুদ্দিনের। কর্মজীবনের শুরুতে বারুইপুর আদালতে মুহুরির কাজ করতেন তিনি। বিয়ে হয় সরিফা বিবি লস্করের সঙ্গে। স্থানীয়দের দাবি, তার পরেই নাকি তরতর করে ‘উন্নতি’ হয়েছে সইফউদ্দিনের। বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন। মুহুরির কাজ করার সুবাদে পুলিশের সঙ্গে বেশ ভাল চেনাজানা তাঁর। তবে সইফুদ্দিনের রাজনীতিতে এসে পড়াটা আচমকা বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় নেতৃত্ব। বস্তুত, ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল হতেই তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন সইফুদ্দিন। কিছু দিনের মধ্যে মুহুরির কাজ ছেড়ে দেন। তার পর জয়নগর থানায় ডাকমাস্টারের কাজ শুরু করেন তিনি। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, তখন থেকেই এলাকায় প্রভাব বাড়তে থাকে সইফুদ্দিনের। ক্রমশ শাসকদলের আরও ঘনিষ্ঠ হন। ২০১৮ সালে বামনগাছি অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি করা হয় সইফুদ্দিনকে। পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট পান স্ত্রী। জেতার পরেই স্ত্রী হন পঞ্চায়েত প্রধান। তার পর থেকে পুরো পরিবারের চালচলনই নাকি বদলে যায়। সইফুদ্দিনের এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘এলাকায় ওর কথাতেই সব চলত।’’

তৃণমূলে এসে চালচলন বদল!

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে স্ত্রীর পাশাপাশি নিজেও ভোটে দাঁড়ান সইফুদ্দিন। সস্ত্রীক ভোটে জেতেন। এ বারও বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হন স্ত্রী সরিফা। মৃত সইফুদ্দিনের ঘনিষ্ঠদের দাবি, রোজ লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেন হত ওঁর হাত ধরে। জীবনযাত্রাতেও বদল আসে। এখন আর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন না সইফুদ্দিন। চোখধাঁধানো বাড়িও তৈরি করেছেন। যদিও সইফুদ্দিনের ব্যবসা ঠিক কিসের, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের দাবি, ব্যবসায়িক শত্রুতার জেরে খুন হয়েছেন তিনি। কিন্তু, তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিনের খুনের ঘটনায় শুরু হয় রাজনৈতিক হিংসা। তৃণমূল এবং সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ২০-২৫ টি বাড়িতে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। লুটপাট হয়েছে। পরিবারের মহিলাদের মারধর করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, বেছে বেছে শুধুমাত্র সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে।

দাবি ও পাল্টা দাবি

সোমবারের এই ঘটনা প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জয়নগরে তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন খুন হয়েছেন। মাফিয়া নেতা বলে ওঁকে এলাকায় সবাই চেনেন। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাফিয়ারাজ চলে। বখরার লড়াইয়ের কথা কে জানে না! যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে এর জন্য অন্য কারও ঘাড়ে দোষ চাপানোর মানে হয় না। দু’জন ধরা পড়েছে। এক জনের হাতে খুন হয়েছেন। তিনিও তৃণমূল। মৃতের পরিবারের সদস্যেরা তো তৃণমূলেরই নেতা। তাঁরা তো দলের কথা অনুযায়ী সিপিএমের ঘাড়েই দোষ চাপাবেন। কারও ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে প্রকৃত খুনিকে খুঁজে বার করা হোক। যথাযথ তদন্ত হোক।’’ অন্য দিকে, ঘটনার খবর পেয়েই পদ্মেরহাট হাসপাতালে ছুটে আসেন স্থানীয় বারুইপুর পূর্ব বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক বিভাস সর্দার। তাঁর দাবি, দুষ্কৃতীরাই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ এখনও পর্যন্ত দু’জনকে ধরতে পেরেছে। হাসপাতালে আসেন জয়নগরের বিধায়ক বিশ্বনাথ দাস। তিনি এই খুনের দায় চাপান বিজেপি এবং সিপিএমের উপরে। আর এক তৃণমূল নেতা শওকত মোল্লার অভিযোগ, ‘‘লোকসভা ভোটে জামানত বাজেয়াপ্ত হবে জেনেই এই খুন পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE