Advertisement
E-Paper

নোট-এ গাছে বিয়ের বাঁধন

ছোট পিসির ননদ তাঁর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাদ। বড় মামার বন্ধু পাড়াতেই থাকেন। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে টেলিফোন করতে যেতাম। তিনিও বাদ। ছেলে কলকাতায় বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে মুর্গ মুসল্লম খেয়ে এসেছে। ইচ্ছা ছিল নিজের বিয়েতেও তাই করার। নির্মম ভাবে সে ইচ্ছে ছেঁটে ফেলতে হচ্ছে। বড়দা বলেছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার প্রিয় খাবার কবিরাজিটা মেনুতে রাখা হোক। নাঃ। তা-ও রাখা যাচ্ছে না। মা বলেছিল, নহবত বসুক। বদলে চালানো হবে রেকর্ড। কেননা, নোটের কোপ মজাইল বিয়ে। সরকার ফরমান দিয়েছে, যাঁদের বিয়ে রয়েছে, তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে আড়াই লাখ করে পাবেন। কিন্তু তা সব জায়গায় মানা হচ্ছে না। অগ্রহায়ণে বিয়ের মরসুমের ঠিক মুখেই তাই নোট কুনাট্য রঙ্গে মাটি হতে বসেছে বাঙালির সাধের বিয়ের আসর। সাধারণ মানুষ থেকে সাংসদ, বিয়ের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারই একঝলক এইখানে। অগ্রহায়ণে বিয়ের মরসুমের ঠিক মুখেই তাই নোট কুনাট্য রঙ্গে মাটি হতে বসেছে বাঙালির সাধের বিয়ের আসর। সাধারণ মানুষ থেকে সাংসদ, বিয়ের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারই একঝলক এইখানে।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০২:১৬
অঙ্কণ: সুমিত্র বসাক

অঙ্কণ: সুমিত্র বসাক

• সাংসদও ফাঁপরে

জলপাইগুড়িতে শাসক দলের সাংসদ বলে কথা। বিজয়চন্দ্র বর্মনের ছেলের বিয়ে ৯ ডিসেম্বর৷ পাত্রী কোচবিহারের৷ রীতিমত পাঁজি দেখেই বিয়ের দিনক্ষণটা ঠিক করা হয়েছিল৷ একমাত্র ছেলের বিয়েতে কোন খামতি না রাখতে প্রস্তুতিও চলছে অনেক দিন ধরেই৷ কিন্তু এখন কী করে কী হবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না বর্মন পরিবার। বিজয়বাবু জানান, ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিলেন৷ কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে মাত্র আড়াই লক্ষ টাকাই তুলতে পারবেন৷ তাও ব্যাঙ্কে যা টাকা আছে তার মধ্যে তাঁকে একবারে অত টাকা দেবে কি না, সন্দেহ রয়েছে। বিজয়চন্দ্র বর্মণও ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্ন পাওয়ার আশা তো অনেকেই করবেন। তাতেই মহা ফাঁপরে পড়ে গিয়েছেন বিজয়বাবু। তাঁর ধারণা, ‘‘অনেক কাটছাঁটের পরও দেখছি সেই টাকায় সবটা হবে না৷ তাই পরিচিতদের কাছে থেকে কিছু টাকা ধারও নিতে হবে ৷ এ ছাড়া প্যান্ডেল ও বাজারেও কিছু বাকি রাখা ছাড়া উপায় নেই৷ পাত্রীর বাড়ির লোকেরাও খুবই সমস্যায় পড়েছেন৷” তাই মেনু থেকে নিমন্ত্রিতদের তালিকা, সবেতেই কাটছাঁট করছেন। সকালে বা রাতে বাড়িতে যখনই একটু সময় পাচ্ছেন বসে পড়ছেন কাগজ পেন নিয়ে৷ লম্বা তালিকা থেকে কিছু বাদ দেওয়া যাবে বুঝতে পারলেই ঘচাৎ করে কেটে দিচ্ছেন৷ তবে সব চেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমন্ত্রিতদের তালিকা নিয়ে৷ সাংসদের কথায়, “সারা দিন এত মানুষের সঙ্গে থাকি ৷ অনেকেই হয়তো আশা করবেন, ছেলের বিয়েতে তাদের আমন্ত্রণ জানাব৷ কিন্তু পরিস্থিতি যা তাতে করে আমন্ত্রিতদের তালিকাও কাট ছাট করা ছাড়া উপায় নেই৷” নিজেরাই বাজার করে রান্না করানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সাংসদকে ৷ তার কথায়, “এতে কিছু টাকা তো বাঁচবে!”

• বন্ধুরাই বাঁচালেন

ধৃতিমান রাহা মালবাজার শহরের বাসিন্দা বড়দিঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক ধৃতিমানের চলতি মাসের আগামী ২৪ ডিসেম্বরে বিয়ে। নোটের সমস্যা সামাল দিতে ধৃতিমান তাঁর কাছের চার বন্ধুর অ্যাকাউন্টে কুড়ি হাজার টাকা করে অ্যাকাউন্ট পে চেক দিয়ে দিচ্ছেন। এর পর সেই বন্ধুদের থেকেই আবার সমপরিমাণ টাকার বিয়ারার চেক নিয়ে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে কিছু নগদ মিলছে। ধৃতিমান বললেন ‘‘এই ভাবনাটা বন্ধুদের মাথার থেকেই বেরিয়েছিল। রুপায়ণ করতে গিয়ে বাবা, মা সকলকেই ব্যাঙ্কে গিয়ে দিনভর লাইন দিয়ে থাকতে হচ্ছে।’’ তাঁর আক্ষেপ বিয়ের আনন্দ মাটি হয়েছে লাইনের গেরোতে।

• আজ বিয়ে কাল নগদ

কুমারগ্রামের এক মহিলা পুলিশকর্মীর সোমবার বিয়ে। অথচ হাতে নগদ একটি টাকাও নেই। বিয়ের খরচের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে নগদ টাকা তুলেছিলেন। কিন্তু ৫০০ হাজারের নোট হওয়ায় পুরো টাকাই আবার ব্যাঙ্কে জমা করে দিতে হয়েছে। ব্যাঙ্কে গিয়ে দু হাজারের বেশি মেলেনি। এটিএম অবস্থাও একই। তিনি জানালেন, চেকে তো আর সব পেমেন্ট করা যাচ্ছে না। ব্যাঙ্কে আবেদনপত্র দিয়েছি। তিনি বলেন, ‘‘বিয়ের আগে টাকা পাব বলে মনে হয় না।’’ তাই পরেই ধার মেটাবেন। শামুকতলার পটটোলা গ্রামের শিক্ষক সৌরভ রায়েরও সোমবার বিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘বড় নোট বাতিল হওয়ায় হাতের সব টাকাই ব্যাঙ্কে জমা করে দিতে হয়েছে। সরকারি ঘোষণা মতো ব্যাঙ্কে বা এটি এমে টাকা মিলছে না। এদিকে বিয়ের জন্য আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার নির্দেশ শনিবার ব্যাঙ্কগুলিতে পৌঁছেছে। বিয়ের কার্ড সহ প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়েছি। অনুমোদন মেলার পর টাকা পাব।’’

• পাড়া-পড়শিরা পাশেই

দক্ষিণ বেরুবাড়ির মানিকগঞ্জের সীমান্তবর্তী চনপাড়ার বাসিন্দা বিধবা মহিলা মোহিনীবালা রায় তার কনিষ্ঠ কন্যার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। পাত্র হলদিবাড়ি থানার উত্তরবড়হলদিবাড়ি গ্রামপঞ্চায়েতের সারিয়াম গ্রামের বাসিন্দা। সোমবার বিয়ে। বিয়ের জন্য তার এক বিঘা জমি সাড়েতিন লক্ষ টাকায় বিক্রি করার জন্য এক লক্ষ টাকা বায়না নিয়েছেন। সেই টাকা আনুষাঙ্গিক খরচে শেষ। বাকি টাকা যিনি জমি কিনেছেন তার বিয়ের আগে দেওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনা ছিল যে বিয়ের আগে সব টাকা পেলে জমিটি লিখে দেবেন। ইতিমধ্যে ৫০০ এবং ১ হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ায় জমি বিক্রি করতে পারেননি। কারণ যিনি জমি কিনেছেন, তিনি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। তবে পাড়া-পড়শিরা এগিয়ে এসেছেন। কোনমতে তারা সবাই মিলে বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। এলাকার বাসিন্দা দক্ষিণ বেরুবাড়ির প্রাক্তন প্রধান সারদাপ্রসাদ দাস বলেন, “কোনও রকমে বিয়েটা দেব। বরযাত্রী আপ্যায়নের কোনও অসুবিধা হবে না। তার বাইরে আর কিছু করা হবে না।”

• বিয়ে না ব্যাঙ্ক

সকালে ইসলামপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, সোমবারই তাঁর বাড়িতে বিয়ে। শুক্রবার ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন তখনও তাঁদের কাছে বিয়ে নিয়ে কোনও নির্দেশ আসেনি। শনিবার ফের টাকা তোলার জন্য বিয়ের কার্ড ও অবেদনপত্র জমা করেছেন তিনি। সোমবার টাকা পাবেন বলে আশায় রয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বিয়ে বাড়িতে লোকজন দেখব। নাকি ব্যাঙ্কে এসে লাইন দেব।’’ ইসলামপুরের দাড়িভিটের বাসিন্দা এক গৃহবধু বেদনা মণ্ডল জানান, আগামী ৯ ডিসেম্বর মেয়ের বিয়ে। ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু ৫০০ ও হাজার টাকার নোট থাকায় সমস্ত টাকাই জমা দিয়ে দিতে হয়েছে। এখন আর টাকা তুলতে পারছেন না। ইসলামপুরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকার একটি রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী জানান, ‘‘ব্যাঙ্কে বিয়ের কার্ড নিয়ে গেলে তা স্ক্যান করে বাইরে পাঠাতে হয়। সেখান থেকে অনুমোদন আসতে একদিন লেগে যায় বলে ওই কর্মী জানিয়েছেন।’’

• এখন না বলতে হচ্ছে

উত্তর দিনাজপুরের এক শহরে মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ অনেক আগেই সেরে ফেলেছিলেন এক ভদ্রলোক। এখন কয়েকজনকে বাধ্য হয়ে না বলতে হচ্ছে। রায়গঞ্জের বীরণগর এলাকার বাসিন্দা পেশায় পোশাক ব্যবসায়ী নিলয় রায়ের আগামী ৯ ডিসেম্বর বিহারের আবাদপুরে বিয়ে ঠিক হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর তাঁর বাড়িতে বৌভাত। নিলয়বাবু জানিয়েছেন, বিয়ের অনুষ্ঠান ও বৌভাতের খরচ বাবদ তাঁর প্রায় ৮ লক্ষ টাকা খরচ হবে। দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের রায়গঞ্জ শাখায় তাঁর দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। একটি সেভিংস ও অন্যটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। বৌভাতের অনুষ্ঠানে ৮০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চেকের মাধ্যমে তিনি বিয়ের অলঙ্কার ও পোশাক কিনেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্যাটারিং, মণ্ডপ, বাজনা, বরযাত্রীর গাড়িভাড়া ও বৌভাতের অনুষ্ঠানের নানা খরচ দিতে। এ সব খরচ চেকের মাধ্যমে নিতে চাইছে না কেউই। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটও চলছে না। বিয়ে ও বৌভাতের খরচ মেটাতে বর্তমানে তাঁর সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দরকার। কিন্তু গত তিন দিন ধরে ব্যাঙ্কে গিয়ে বিয়ের কার্ড দেখিয়েও টাকা মিলছে না। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলেছেন, বিয়ের কার্ড দেখিয়ে আড়াই লক্ষ টাকা দেওয়ার কোনও সরকারি নির্দেশ নেই। ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা ও সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে ২৪ হাজার টাকার বেশি তোলার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি। ওই টাকায় বিয়ে ও বৌভাতের খরচ মেটানো সম্ভব হবে না। তাই বর্তমানে বিয়ের কার্ড দেখিয়ে আড়াই লক্ষ টাকা তোলার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি।

• নির্দেশ এখনও আসেনি

জলপাইগুড়ির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিক জানান, বিয়ের জন্য আড়াই লক্ষ টাকা তুলতে দেওয়ার কোন নির্দেশ তাঁরা এখনও পাননি৷ সোমবারই বিয়ে জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া মোহিতনগরের দিব্যেন্দু দাসের৷ একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী দিব্যেন্দু জানান, তিনি খুব বড় আয়োজন করেননি৷ কিন্তু তারপরও ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা তুলতে পারেননি। অগত্যা সব জায়গাতে বাকি রাখতে হচ্ছে তাঁকে৷ জলপাইগুড়ির আর এক বাসিন্দা হিমাংশু দাসের সোমবার বিয়ে৷ অনেক আগে থেকেই ব্যাঙ্কে কিছু কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু এখন তো মাঠে মারা পড়লাম৷ টিভিতে দেখছি বিয়ের কার্ড দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে আড়াই লক্ষ টাকা তোলা যাবে৷ কিন্তু বাস্তবে তো তা হচ্ছেই না৷ তাই ক্যাটারার থেকে প্যান্ডেল সবারই হাতে ধরতে হচ্ছে৷’’

• বাজেট কমে ৫০ হাজার

হলদিবাড়ির শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দীনেশ রায় তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন হলদিবাড়ি থানার দেওয়ানগঞ্জ গ্রামপঞ্চায়েতের নয়ার হাট গ্রামে। পাত্র সিআরপিতে কাজ করেন। সোমবার বিয়ে। মেয়ের বিয়ের জন্য সারা জীবন হলদিবাড়ির এসবিআইএর শাখায় টাকা জমিয়েছেন। এখন সেই টাকা তুলতে পারছেন না। শনিবার মাত্র দশ হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন। ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধকের কাছে বিয়ের কার্ড এবং তাঁর পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। টাকা পাননি। দীনেশ রায় বলেন, “ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কোনও টাকা দিতে পারবেননা। আমি ৫০ হাজার টাকা পেলেই বিয়েটা দিয়ে দিতে পারি। সোমবার আবার ব্যাঙ্কে যাব।’’

Wedding season demonetisation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy