Advertisement
০৬ মে ২০২৪

কালেভদ্রে তল্লাশি, যাত্রী-সুরক্ষা অথৈ জলে

অতীতে চলন্ত ট্রেনের কামরায় গুলি করে ব্যবসায়ীকে খুন করা বা স্টেশনে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় নিত্যযাত্রীদের জখম হওয়ার ঘটনার নজির রয়েছে বনগাঁয়। সাম্প্রতিক সময়ে স্টেশনে গুলি করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অথচ আজও দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকাল ট্রেন বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই তিমিরেই।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৫ ০১:৪৮
Share: Save:

অতীতে চলন্ত ট্রেনের কামরায় গুলি করে ব্যবসায়ীকে খুন করা বা স্টেশনে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় নিত্যযাত্রীদের জখম হওয়ার ঘটনার নজির রয়েছে বনগাঁয়। সাম্প্রতিক সময়ে স্টেশনে গুলি করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অথচ আজও দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকাল ট্রেন বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই তিমিরেই।

প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন ওই লোকাল ট্রেনে। অথচ যাত্রীদের ন্যূনতম নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। ট্রেনের কামরায় কোনও সমস্যা হলে রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখা যায় নিত্য যাত্রীদেরই। মঙ্গলবার আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণের পরে বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল ট্রেনের যাত্রীরাও জানিয়েছেন, তাঁরাও নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।

সাধারণ যাত্রীরা অনেকে জানালেন, ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের একা‌শের রীতিমতো ‘দাদাগিরি’ চলে সিট বুকিং নিয়ে। গেট বা দু’টি সিটের মাঝে দাঁড়ানোর জায়গা আটকে তাস খেলা হয়। সে সব নিয়ে কথা বলতে গেলেই কটূক্তি জোটে। ট্রেন থেকে গলার সোনার হার ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে আকছার। স্টেশন চত্বরে চোলাই মদ বিক্রি হয়। চলে জুয়া খেলা।

রেল পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার গুমা, গোবরডাঙা, অশোকনগর স্টেশনে দুষ্কৃতীরা গুলি করে বা অ্যাসিড মেরে খুনও করছে। তারপরেও নামকাওাস্তে মাঝে মধ্যে তল্লাশি চলে। ফের অবস্থা যে কে সেই।

বনগাঁ স্টেশন থেকে বহু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ট্রেনে যাতায়াত করে। মাঝে মধ্যে পুলিশ তাদের ধরেও ফেলে। ওই সব অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাংলাদেশি দুষ্কতী থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিহারের মুঙ্গের থেকে ট্রেনে করেই এখানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে। হেরোইন-সহ নানা কিছু পাচার চলে রেলপথেই।

বনগাঁ-রানাঘাট লোকাল ট্রেনেও একই অবস্থা। নিরাপত্তা কিছুই থাকে না। বেশি রাতে ওই ট্রেনে করে যাতায়াত করতে মানুষ ভয় পান। স্থানীয় আকাইপুর স্টেশনের কাছে ট্রেনের যাত্রীদের লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়ার ঘটনাও ঘটেছে। রাতে এ দিকের কয়েকটি স্টেশন দুষ্কৃতীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয় বলে অভিযোগ। বনগাঁ জিআরপি সূত্রের খবর, বিশেষ কয়েকটি স্টেশনে রাতে ‘নাইট পিকেট’ থাকে। তবে তা সব স্টেশনে দেওয়া সম্ভব হয় না।

মঙ্গলবার বোমা বিস্ফোরণের পরে বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, বনগাঁ জিআরপির ওসি তপজ্যোতি দাস দলবল নিয়ে স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ব্যাগপত্তর পরীক্ষা করছেন। রেল পুলিশ সূত্রে জানা গেল, উপর মহলের নির্দেশেই ওই চেকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে রেল পুলিশের কর্মীরা যাত্রীদের ব্যাগ থেকে মালপত্র বের করে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করছেন। তবে ওইটুকুই। বনগাঁ জিআরপির অধীনে রয়েছে ওই রেলপথের ১৩টি স্টেশন (বনগাঁ থেকে বারাসতের কারশেড পর্যন্ত)। মোট দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার। বনগাঁ স্টেশন ছাড়া অন্য কোনও স্টেশনে অবশ্য ওই দিনও খানা-তল্লাশি চোখে পড়েনি। যদিও চেকিং যা হয়েছে প্ল্যাটফর্মের উপরেই। কামরায় কোনও নজরদারি হয়নি।

নিত্যযাত্রীরা জানালেন, এক দিনের জন্য হলেও তবু পুলিশ দেখা গেল। বছরের অন্য দিনগুলিতে পুলিশ দেখা যায় না। আর ট্রেনের কামরায় তল্লাশি শেষ কবে দেখা গিয়েছে তা মনে করতে পারলেন না নিত্যযাত্রীরা। অনেকের কথায়, ‘‘ট্রেনের কামরায় ও স্টেশনে নিরাপত্তা অভাব রয়েছে যথেষ্ট। কোনও ঘটনা ঘটলে প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেই। ফলে ট্রেন ও স্টেশন দুষ্কৃতী সহজ টার্গেট হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’ হাবরা শহরের বাসিন্দা এক মহিলার অভিজ্ঞতায়, ‘‘শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে ফিরছিলাম। হাবরা স্টেশনে নামার ঠিক আগের মুহূর্তে গলায় থাকা সোনার চেনটি দুষ্কৃতীরা ভিড়ের মধ্যে এমন ভাবে টেনে ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল যে গলায় কেটে গিয়েছিল। দুষ্কৃতীরা নিমেষের মধ্যে ভিড়ের মধ্যে মিশে পালিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।’’ যাত্রীরা জানালেন বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগস্ট— ঘটা করে স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের তল্লাশি চোখে পড়ে। অন্য সময়ে তাদের দেখা মেলে না। নিত্যযাত্রী ও সাধারণ মানুষ অনেকে জানালেন, কামরা হোক বা স্টেশন চত্বর ও রেল লাইনের ধার দুষ্কৃতীদের কাছে পছন্দের এলাকা হয়ে উঠেছে। কারণ, এখানে অপরাধ করলে গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কেন নিরাপত্তার এমন গাফিলতি?

জিআরপি সূত্রের খবর, বনগাঁ জিআরপির অধীনে (যার মধ্যে হাবরা জিআরপিও রয়েছে) তিনজন এসআই, পাঁচজন এএসআই, ৩৪ জন কনস্টেবল-সহ মোট ৪২ জন পুলিশ কর্মী। বনগাঁ-শিয়ালদহ ও বনগাঁ-রানাঘাট লোকাল মিলিয়ে তাদের অধীনে রয়েছে ২১টি স্টেশন। মোট দূরত্ব ৮৩ কিলোমিটার। ওই পুলিশ ফোর্স দিয়ে ট্রেনের কামরায় বা সব স্টেশন তল্লাশি বা টহল চালানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া, কোনও ঘটনার তদন্তের কাজে পুলিশ কর্মীরা যুক্ত থাকেন। গ্রেফতার হওয়া অপরাধীদের আদালতে নিয়ে যেতে হয় তাঁদের। সর্বোপরি রয়েছে ভিআইপি ডিউটির চক্কর। সে জন্যও পুলিশ পাঠাতে হয়। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সব জায়গায় সমান ভাবে তল্লাশি চালানো সম্ভব হয় না। বনগাঁ জিআরপি-র রয়েছে একটি মাত্র মেটাল ডিটেক্টর। যা দিয়ে প্রতিটি স্টেশনে ট্রেনের কামরায় তল্লাশি চালানো সম্ভব হয় না। তা ছাড়া, স্টেশন চত্বরে ঢোকার রাস্তা প্রচুর। কে কোথা দিয়ে ঢুকে পড়ছে, তা ঠেকানো কার্যত অসম্ভব।

বুধবার দুপুরেও বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে টিকিট কাউন্টারের সামনে জিআরপির পক্ষ থেকে ব্যাগপত্তর খুলে তল্লাশির কাজ চলছে। সন্দেহজনক কাউকে মনে হলে বিশেষ করে বাংলাদেশিদের নাম-ঠিকানা, গন্তব্য জানতে চাওয়া হচ্ছে। তবে গোটা স্টেশন চত্বরে মধ্যে একমাত্র টিকিট কাউন্টারের সামনেই মূলত চেকিং চলছে।

কেন ট্রেনের কামরায় চেকিং করা হয় না? জিআরপির দাবি, বনগাঁ থেকে ট্রেন গোবরডাঙা পর্যন্ত পৌঁছলেই এমন ভিড় হয়ে যায় যে মানুষ ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারেন না। ওই ভিড়ের মধ্যে মালপত্র পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

simanto moitra bongaon train security rail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE