Advertisement
০৫ মে ২০২৪
kurmi tribe

কুড়মালির লড়াইয়ে রোজই মাতৃভাষা দিবস জয়ন্ত, নারায়ণদের

কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে জঙ্গলমহলের মূলবাসী কুড়মিদের একাধিক সংগঠন দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন করে চলেছে। পাশাপাশি, জয়ন্ত ও নারায়ণের মতো কুড়মি শিক্ষাব্রতীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষা প্রসারে কাজ করে চলেছেন।

বাঁ দিক থেকে, জয়ন্ত মাহাতো ও নারায়ণ মাহাতো। কুড়মালি পাঠ্যবই ।নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিক থেকে, জয়ন্ত মাহাতো ও নারায়ণ মাহাতো। কুড়মালি পাঠ্যবই ।নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

জয়ন্ত মাহাতো ও নারায়ণ মাহাতোর কাছে প্রতিটি দিনই ভাষা দিবস। কুড়মি সম্প্রদায়ের এই দুই প্রতিনিধি মাতৃভাষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

ছ’টি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি মানুষ কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। অথচ জাতীয়স্তরে ভাষার স্বীকৃতি মেলেনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশ্য কুড়মালিকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অসম এবং ছত্তীসগঢ়ে বসবাসকারী কুড়মিরা (মাহাতো) এই ভাষায় কথা বলেন। কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে জঙ্গলমহলের মূলবাসী কুড়মিদের একাধিক সংগঠন দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন করে চলেছে। পাশাপাশি, জয়ন্ত ও নারায়ণের মতো কুড়মি শিক্ষাব্রতীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষা প্রসারে কাজ করে চলেছেন।

‘অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসইআ সোসাইটি’র সম্পাদক জয়ন্ত মাহাতো ১৯৮৬ সালে ‘কুড়মালি চিসই’ লিপি তৈরি করেন। বহুল ব্যবহৃত চিসই লিপির এখনও সরকারি স্তরে স্বীকৃতি মেলেনি। আগে কুড়মালি ভাষার নিজস্ব লিপি ছিল না। অঞ্চল বিশেষে দেবনাগরী, বাংলা ও ওড়িয়া হরফ ব্যবহার করা হত। ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু কলেজে আইএ থেকে স্নাতক স্তরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমএ পর্যন্ত কুড়মালি পড়ার সুযোগ রয়েছে। স্নাতকোত্তরে অবশ্য দেবনাগরী বা ইংরেজি রোমান হরফে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে।

এই কারণেই ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা পেশায় স্কুলশিক্ষক জয়ন্ত স্বতন্ত্র ‘চিসই’ লিপি তৈরি করেন। চিসই কথার অর্থ চিহ্ন। জয়ন্তের সংগঠনের উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া জেলায় ১৫টি অস্বীকৃত কুড়মালি প্রাথমিক স্কুল চ‌লছে। জয়ন্ত বলেন, “২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনে বলা আছে, শিশুর শিক্ষার মাধ্যম হবে তার মাতৃভাষা। ভাষাগত সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া শিশুরা যাতে কোনও মতেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে কথাও আইনে বলা আছে। কিন্তু কুড়মি-শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভে বঞ্চিত হচ্ছে। কুড়মি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে এখনও সরকারি ভাবে প্রাথমিক স্তরে কুড়মালি ভাষায় পঠন পাঠন চালু করা হয়নি।” স্কুলের কুড়মালি পাঠ্যবই লিখেছেন ও সংকলন করেছেন জয়ন্ত মাহাতো ও জামবনির দর্পশিলা গ্রামের নারায়ণ মাহাতো। সম্প্রতি ঝাড়গ্রাম জেলা ঝুমুর মেলায় কুড়মালি পাঠ্যবইয়ের স্টল দেখে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কুড়মালি স্কুলগুলিকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আওতায় নিয়ে আসার আশ্বাসও দিয়েছেন।
কুড়মালি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলার অপভ্রংশ, কারও মতে ওড়িশি ভাষার অপভ্রংশ। জয়ন্তর অবশ্য দাবি, প্রাক-বৈদিক দ্রাবিড়-গোষ্ঠীর ভাষা হল কুড়মালি। সংস্কৃত বা তার কোনও উপভাষা থেকে কুড়মালির উৎপত্তি হয়নি। ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র মালদহের গৌড় কলেজের বাংলার অধ্যাপক ক্ষিতীশ মাহাতোর দাবি, চতুর্দশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ কুড়মালি শব্দ এবং ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের লক্ষণ স্পষ্ট ভাবে রয়েছে। কুড়মালি লোকসাহিত্য ও ঝুমুর গানের ধারাটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তবে কুড়মালিতে লিখিত সাহিত্য অপ্রতুল। গত তিন দশক ধরে কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।

নিজের তৈরি করা কুড়মালি লিপি ও ব্যাকরণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে জানিয়েছেন জয়ন্ত। তাঁর দাবি, দেশের দু’কোটি মানুষের মুখের ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক। কুড়মালি অভিধান সংকলনের কাজ শেষ করে ফেলেছেন নারায়ণ। অভিধান ছাপার কাজ চলছে। দুই ভাষা-সেবকই বলছেন, ‘‘সরকারি স্বীকৃতি অধরা। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষা প্রসারের কাজ করছি। প্রতিটা দিনই আমাদের কাছে ভাষা দিবস।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kurmi Tribe International Mother Language Day 2020
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE