Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূল-বিক্ষুব্ধদের ভিড় বিজেপিতে, ফিরছে হিংসাও

মারের জবাবে পাল্টা মার! সেই এলাকা দখল এবং পুনর্দখল ঘিরে রক্তপাতের রাজনীতি! পুলিশ-প্রশাসনের সেই একই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা! বীরভূমের পাড়ুইয়ে গ্রামদখল ঘিরে রাজনৈতিক সংঘর্ষ মনে করিয়ে দিচ্ছে কয়েক বছর আগে বাংলার সেই চেনা ছবি। পাড়ুইয়ে কয়েক দিন আগে পুলিশের উপরে হামলা এবং এ বার সংঘর্ষে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় সামনে এসেছে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির বিবাদ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

মারের জবাবে পাল্টা মার! সেই এলাকা দখল এবং পুনর্দখল ঘিরে রক্তপাতের রাজনীতি! পুলিশ-প্রশাসনের সেই একই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা! বীরভূমের পাড়ুইয়ে গ্রামদখল ঘিরে রাজনৈতিক সংঘর্ষ মনে করিয়ে দিচ্ছে কয়েক বছর আগে বাংলার সেই চেনা ছবি।

পাড়ুইয়ে কয়েক দিন আগে পুলিশের উপরে হামলা এবং এ বার সংঘর্ষে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় সামনে এসেছে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির বিবাদ। এই ঘটনাপ্রবাহ অনেককেই মনে করিয়ে দিচ্ছে বাম জমানায় কেশপুর-নন্দীগ্রামে সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা। তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের শিবির ছেড়ে সেই সময় বিরোধী দল তৃণমূলে নাম লেখানোর প্রবণতা যত বাড়ছিল, তত উত্তপ্ত হচ্ছিল রাজ্য-রাজনীতি। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ কয়েক বছর রাজনৈতিক সংঘর্ষ বারেবারেই শিরোনামে এসেছে, যার অভিঘাত পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত। সোমবারের ঘটনার পরে দেখা গেল, সব একই আছে, বদলছে শুধু দলগুলির ভূমিকা। তৃণমূল এখন শাসক। আর তাদের ফেলে আসা বিরোধীর জায়গাটা নিয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে আশ্রয় পেতে সুবিধা হবে ভেবে তৃণমূল ছেড়ে বিক্ষুব্ধরাও যাচ্ছেন বিজেপির ছাতার তলা। আর বিজেপির শক্তি বাড়ছে বলেই তৃণমূূলের সঙ্গে তাদের বিবাদও বেড়ে চলেছে।

এই পরিবর্তিত সমীকরণেরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ বীরভূম। ওই জেলায় গত কয়েক বছর ধরে প্রবল প্রতাপ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের। জমানা বদলের পরে এই দাপুটে নেতার ছত্রচ্ছায়ায় চলে আসেন সিপিএম-সহ জেলার বাম কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ। আবার অনুব্রতর দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে তৃণমূল ছেড়ে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির দিকে ভিড়ছেন হৃদয় ঘোষের মতো অনেকে। ঘটনাচক্রে, পাড়ুই ও সংলগ্ন এলাকার বেশ কিছু গ্রাম সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হওয়ায় বিজেপির বাড়তি রাজনৈতিক সুবিধাও হচ্ছে। তারা দেখাতে পারছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে মোটেও তৃণমূলের একচ্ছত্র প্রভাব নেই। প্রকাশ্যে না বললেও বিজেপির অন্দরের ব্যাখ্যা, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরাতেই ‘বীরভূম লাইন’ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

তবে এই লাইন নিতে গিয়ে উত্থানের সময়েই যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা-ও মানেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ। বিশেষত, তৃণমূলের মতোই বাছবিচার না করে দলে নেওয়ার ঘটনা বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে দলের মধ্যে একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে। তবে দলকে শক্তিশালী করার তাগিদে এখনও পর্যন্ত গুরুতর বিতর্কে যাননি বিজেপি নেতারা।

বীরভূমে সিপিএমের আশ্রয় ছেড়ে আসা যে সব ‘সমাজবিরোধী’ এলাকা দখলে অনুব্রত গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছিল, এখন তাদের অনেককেই বিজেপি-র হয়ে একই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে! চৌমণ্ডলপুরের ঘটনায় যে সদাই শেখের নাম জড়িয়েছে, সে আগে অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ অনুগামী শেখ মুস্তাফার লোক ছিল। এখন সে বিজেপি করে। ইলামবাজার ব্লকের পঞ্চায়েতগুলির প্রায় সব ক’টি অনুব্রতের অনুগামীদের হাতে থাকায় এলাকা দখলে দু’পক্ষের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যার ফলে লোকসভা ভোটের পরে ইলামবাজারেই বিজেপির দুই কর্মী খুন হয়েছেন। তৃণমূলের এক অঞ্চল সভাপতিও জখম হয়েছেন।

এলাকার শাসক দলের দাপুটে নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠার ঘটনা কিন্তু বীরভূমেই সীমাবদ্ধ নেই। হুগলির আরামবাগ, খানাকুল বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও ঘটছে একই ঘটনা। ভাঙড়ে কোথাও সংঘর্ষ হচ্ছে তৃণমূলেরই আরাবুল গোষ্ঠীর সঙ্গে পাল্টা গোষ্ঠীর, কোথাও শাসক দলের সঙ্গে নব্য বিজেপির। কারণ, কংগ্রেস বা সিপিএম কারওরই এখন আশ্রয় দেওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি নেই।

সংঘর্ষ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে চাপানউতোরও। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বীরভূমের মাখড়া গ্রামের ঘটনার জন্য এ দিন দোষারোপ করেছেন বিজেপিকেই। পার্থবাবুর বক্তব্য, “জেলা সভাপতির কাছে রিপোর্ট চেয়েছি। তবে যা দেখছি, বিরোধীদের প্ররোচনায় দুষ্কৃতীরা বোমা তৈরি করছে। বিজেপির প্ররোচনামূলক রাজনীতির শিকার হয়েছেন তৃণমূলের শেখ সুলেমান (তখনও শাসক দলের এক জনের মৃত্যুর খবর ছিল)।” তাঁর আরও হুঁশিয়ারি, “বিভেদ সৃষ্টির রাজনীতি বিজেপি যেন বাংলায় না করে। মানুষ প্রতিরোধ করবেন।”

আবার বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের পাল্টা দাবি, নন্দীগ্রামে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর মতোই মাখড়া গ্রামে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা পুলিশের সাহায্যে সাধারণ মানুষের উপরে হামলা করেছে। তাঁর দাবি, চৌমণ্ডলপুর বা মাখড়ায় গ্রামবাসীরা আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাই তৃণমূল হতাশাগ্রস্ত হয়ে গ্রামগুলি পুনর্দখলের জন্য বাইরের দুষ্কৃতীদের নিয়ে আক্রমণ করেছে। রাহুলবাবু বলেন, “মাখড়া গ্রামের পুরো ঘটনা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানাব। আর রাজ্য পুলিশের উপরে আমাদের আস্থা নেই। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি, সিবিআই বা এনআইএ’কে দিয়ে মাকড়ার ঘটনার তদন্ত করান।” পাড়ুইয়ের ঘটনার প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার বিজেপির রাজ্য দফতর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মৌনী মিছিল হবে। আগামী বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বীরভূমে থেকে ঘটনার প্রতিবাদে ধর্না দেবেন অভিনেতা ও বিজেপি নেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়।

রাজ্য রাজনীতির চেনা ছকের দিকে ইঙ্গিত করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “নন্দীগ্রামের প্রথম স্তরে যে ভাবে পূর্ব মেদিনীপুরকে লক্ষ্মণ শেঠের কয়েদখানায় পরিণত করতে চেয়েছিল সিপিএম, পাড়ুই বা ভাঙড়ে একই রকম দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে! পরিবর্তন কি সত্যিই হয়েছে?” কংগ্রেসের আর এক নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যও বলেছেন, “সিপিএম যে ভাবে গ্রাম দখল করত, আজ তৃণমূল সেই কায়দাতেই দখল অভিযানে নেমেছে। পতাকার রং আলাদা হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতির পরিবর্তন হয়নি!” পাশাপাশি, এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুর বক্তব্য, “তৃণমূল ও বিজেপির ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ওই আক্রমণ বন্ধ এবং দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”

করুণ অবস্থায় পড়েছে সিপিএম-ই। একে তাদের সাংগঠনিক হাল ভাল নয়। তার উপরে যে ঘটনায় তাদের সরাসরি কোনও ভূমিকা নেই, সেখানেও সিপিএমের অতীত টেনে সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী অভিযোগ করেছেন, “শাসক দলের মদতে ভাঙড় বা বীরভূমের গ্রামগুলি অস্ত্রাগারে পরিণত হয়েছে অনেক দিনই। তৃণমূল ও প্রশাসন কিছু না করায় সর্বত্রই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মাথা চাড়া দিয়েছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE