Advertisement
১০ মে ২০২৪
সাংবাদিক নিগ্রহ

জারি নাটক, অনুতাপ জানালেন ‘হোতা’ই

এক দিকে পুরো ঘটনার দায় বিরোধী সিপিএমের ঘাড়ে চাপানো। অন্য দিকে আহত সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে ‘অনুশোচনা’ জ্ঞাপন। পুরভোটে ব্যাপক সন্ত্রাস এবং সাংবাদিক-নিগ্রহের পরদিন পুরোদস্তুর নাটক বজায় রাখল রাজ্যের শাসক দল।

সাংবাদিকদের শাসানি চলছে তখন। হাজির দুই তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসু ও পরেশ পাল। শনিবার ভোটপর্বের শেষে সল্টলেকে এটিআই বুথের বাইরে। —নিজস্ব চিত্র।

সাংবাদিকদের শাসানি চলছে তখন। হাজির দুই তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসু ও পরেশ পাল। শনিবার ভোটপর্বের শেষে সল্টলেকে এটিআই বুথের বাইরে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৩
Share: Save:

এক দিকে পুরো ঘটনার দায় বিরোধী সিপিএমের ঘাড়ে চাপানো। অন্য দিকে আহত সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে ‘অনুশোচনা’ জ্ঞাপন। পুরভোটে ব্যাপক সন্ত্রাস এবং সাংবাদিক-নিগ্রহের পরদিন পুরোদস্তুর নাটক বজায় রাখল রাজ্যের শাসক দল।

রবিবার তৃণমূল ভবনে দলের দুই বর্ষীয়ান নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় সিপিএমের বিরুদ্ধেই ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাস’ চালানোর অভিযোগ এনেছেন। সেই ‘সন্ত্রাসে’র প্রতিবাদে কাল, মঙ্গলবার শহরে যে মিছিল ডাকা হয়েছে, এ দিন তার প্রস্তুতি বৈঠক করেন পার্থবাবুরা। বৈঠক সেরে সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘সিপিএমের গৌতম দেব আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, বিধাননগরে চার-পাঁচ হাজার লোক আনবেন। বোঝা যাচ্ছে, বহিরাগতদের এনে সিপিএম যা ঘটিয়েছে, তা পূর্বপরিকল্পিত!’’

কিন্তু সুজিত বসু, পরেশ পাল, অর্জুন সিংহের মতো তৃণমূল বিধায়কদের পাশাপাশি পবিত্র বিশ্বাসের মতো কলকাতা পুরসভার দলীয় কাউন্সিলরকেও শনিবার বিধাননগরে সপার্ষদ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। অর্জুন তো আটকদের ছাড়াতে থানাতেও গিয়েছেন! তা হলে কি ওঁরা গৌতম দেবের নির্দেশ পালন করছিলেন?

প্রশ্ন শুনে পার্থবাবুর জবাব, ‘‘টিভিতে দেখা গিয়েছে মানেই ওঁরা অপরাধ করেছেন, তা তো নয়! কারা, কী ভূমিকা পালন করেছেন, সবই খোঁজ নিয়ে দেখব।’’ এ দিন সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলে শাসকের আক্রমণের মুখে পড়েছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও।


সাংবাদিকদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদ রায়গঞ্জে। —নিজস্ব চিত্র।

এক দিকে যখন তৃণমূল নেতৃত্বের এ হেন মনোভাব, তখন আহত সাংবাদিকদের দেখতে এ দিন হাসপাতালে হাজির হয়ে চমক দিয়েছেন বিধাননগরের তৃণমূল বিধায়ক সুজিতবাবু। নিগ্রহপর্বের অন্যতম কাণ্ডারী হিসেবে যাঁর দিকে আঙুল উঠেছে।

ওঁর সামনেই তো সাংবাদিকদের পেটানো হল! তিনিই আবার হাসপাতালে? সুজিতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘অনুশোচনা থেকেই এসেছি।’’ এই কথার মধ্য দিয়ে পরোক্ষে তিনি নিজের ভূমিকাই স্বীকার করে নিলেন বলে বিরোধীদের দাবি। শনিবার চ্যানেলে চ্যানেলে দেখা গিয়েছে, সুজিতবাবু উত্তেজিত হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার পরেই বহিরাগতদের হামলা শুরু হয়। সুজিতবাবুকে আঙুল উঁচিয়ে কিছু ‘নির্দেশ’ দিতেও দেখা গিয়েছে।

এ দিন সুজিতকে সরাসরি প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য সাংবাদিক নিগ্রহ বা ভোট সন্ত্রাসে জড়িত ছিলেন বলে মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘আমি কাউকে কোনও নির্দেশ দিইনি। আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা মানেই নির্দেশ দেওয়া নয়!’’ তা হলে ‘অনুশোচনা’ কীসের, সদুত্তর নেই। প্রশাসন যদি নিগৃহীত সাংবাদিকদের প্রতি সহমর্মী হয়, তা হলে কেন কেউ গ্রেফতার হল না? বিধায়কের জবাব, ‘‘এ ব্যাপারে প্রশাসন ও কমিশন যা বলার বলবে। এটা তাদের দায়িত্ব।’’ পুরভোটের সল্টলেকে তিনি কেন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন জানতে চাওয়া হলে বিধায়কের ব্যাখ্যা, ‘‘এলাকা শান্ত করতে এমএলএ হিসেবে গিয়েছিলাম।’’

কিন্তু তাঁর পাশে পরেশ বা অর্জুন কী করছিলেন? সুজিতবাবু বলেন, ‘‘বিরোধীদের হাতে আমাদের কর্মীরা আক্রান্ত শুনে ওঁরা দেখতে এসেছিলেন।’’ ওঁর দাবি, ‘‘সিপিএম প্রার্থী রমলা চক্রবর্তীও বাইরের লোক এনেছিলেন।’’ তবে কি উনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, তৃণমূলও বহিরাগত এনেছিল? বিধাননগরের বিধায়ক প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়েছেন।

প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে বিধাননগর পুলিশের একাংশের দাবি, সল্টলেক এটিআইয়ের সামনে সাংবাদিক পেটানোয় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল ও লেকটাউনের দুষ্কৃতীরা জড়িত। দুই বিধায়কের সঙ্গে শতাধিক বহিরাগত সেখানে জড়ো হয়েছিল। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর চিত্র সাংবাদিক সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে প্রহারের ঘটনায় এক তৃণমূল বিধায়কের গাড়িচালকের নামও জড়িয়েছে। যদিও ধরা পড়েনি কেউ। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, নিগ্রহকারীদের কারও কারও ছবি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখানো হলেও পুলিশ এখনও কাউকে চিহ্নিত করে উঠতে পারেনি! ওই ঘটনায় সল্টলেকের বিভিন্ন থানায় মোট তিনটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

কমিশনারেটের একটি সূত্রে অবশ্য ইঙ্গিত, নিগ্রহের প্রতিটি ঘটনায় তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে। এমন তথ্যও মিলছে যে, সুজিতবাবু-পরেশবাবুর সামনেই বহিরাগতেরা দুই মহিলা সাংবাদিক-সহ মিডিয়ার একাধিক কর্মীর উপরে চড়াও হয়েছিল। তদন্তকারীরা এ দিন হাসপাতালে গিয়ে আহত সাংবাদিকদের বয়ান নথিবদ্ধ করেছেন। ফুটেজ জোগাড় করা হচ্ছে। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম মুখ খুলতে না-চাইলেও সূত্রের খবর, ক্ষুব্ধ সিপি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

তবু পুলিশ কত দূর এগোতে পারবে, পার্থবাবুর মন্তব্যে সেই সংশয় ঘনীভূত। নিগ্রহ অন্যায় হয়েছে বলে মন্তব্য করেও পার্থবাবু এ দিন বলেছেন, ‘‘সাংবাদিকদের কাজও নির্দিষ্ট। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ভিতরে তাঁদের কী কাজ ছিল, সেটাও তো দেখতে হবে! দেখতে হবে, কী প্ররোচনা ছিল।’’ কিন্তু বুথে বা গণনাকেন্দ্রে ঢোকার জন্যই তো কমিশন সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র দেয়! উপরন্তু শনিবার অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে বুথের বাইরে। তা হলে সাংবাদিকদের ‘এক্তিয়ার’ নিয়ে প্রশ্ন কীসের ভিত্তিতে?

পার্থবাবু বলেন, ‘‘হামলা সমর্থন করছি না। আমরা বলেছি, অন্যায় যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

নিগ্রহের শিকার এবিপি আনন্দের অরিত্রিক ভট্টাচার্য ও চিত্র-সাংবাদিক পার্থসারথি চক্রবর্তী এখন সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল-সূত্রের খবর, অরিত্রিকের নাকের দু’টি হাড়ে চিড় ধরেছে। তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। শনিবার রাতেও তাঁর নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আজ, সোমবার ডাক্তারেরা আরও কিছু পরীক্ষা করবেন। ওই হাসপাতালেই ভর্তি রয়েছেন ‘২৪ ঘণ্টা’র আহত এক চিত্র-সাংবাদিক। এ দিন ওঁদের দেখতে যান সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের নেতারা। যান ‘আক্রান্ত আমরা’র সদস্যরাও। কলকাতা টিভির চিত্র সাংবাদিক তন্ময় দত্তবিশ্বাসের অবস্থা স্থিতিশীল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE