Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলে প্রাপ্তি ধমক

দলের রাজ্য সভাপতি কর্মিসভায় সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠা চলবে না। কবুল করছেন, অস্বচ্ছতাই তাঁদের দলকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। আর বাস্তবে দুর্নীতি এবং তোলাবাজির অভিযোগ পেয়েও নড়েচড়ে বসছেন না রাজ্য নেতৃত্ব। বরং তা প্রকাশ্যে এসে পড়ায় অভিযোগকারী বিধায়ককেই তিরস্কার করছেন দলের মহাসচিব!

তপন চট্টোপাধ্যায়

তপন চট্টোপাধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

দলের রাজ্য সভাপতি কর্মিসভায় সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠা চলবে না। কবুল করছেন, অস্বচ্ছতাই তাঁদের দলকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। আর বাস্তবে দুর্নীতি এবং তোলাবাজির অভিযোগ পেয়েও নড়েচড়ে বসছেন না রাজ্য নেতৃত্ব। বরং তা প্রকাশ্যে এসে পড়ায় অভিযোগকারী বিধায়ককেই তিরস্কার করছেন দলের মহাসচিব!

এমনই বিচিত্র ঘটনা ঘটছে তৃণমূলের অন্দরে! দলীয় নেতৃত্ব শুদ্ধকরণের যে বার্তা দিয়েছেন, তার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। স্পষ্ট করে দিচ্ছে কথা ও কাজের ফারাক!

তোলাবাজির অভিযোগ প্রকাশ্যে এনে সাম্প্রতিকতম বিতর্কটি বাধিয়েছেন বর্ধমানের পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। নেতা-কর্মীরা তোলাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন বলে গত ১৯ অক্টোবর দলেরই এক বিজয়া সম্মিলনীতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তপনবাবু। তাঁর দাবি, এর আগেই দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে তিনি গোটা বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ব্যাপারটা দেখবেন।

এর পরে ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তৃণমূল ভবনে এক বৈঠকে যোগ দিতে এসে দলের শীর্ষ নেতাদের সেই ‘তোলাবাজি’ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্রও দেখান তপনবাবু। তাঁর দাবি, সে দিন মুকুল রায়, পার্থবাবু, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী-সহ কয়েক জন নেতার কাছে এর প্রমাণ হিসেবে ‘৫০০০ টাকা’ লেখা সাদা খাম তুলে দেন তিনি। তৃণমূলের নামে ছাপানো বিলের নমুনাও দেন। বিধায়কের দাবি, তখনও নেতারা আশ্বাস দেন, বিষয়টি দেখা হবে। এর পাঁচ দিন পরেও অবশ্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে মঙ্গলবার তপনবাবুর বিজয়া সম্মিলনীর সেই বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে এসে যায়। এবং পার্থবাবু ফোন করে তপনবাবুকেই ধমক দেন!

কেন তিনি প্রকাশ্যে এই ধরনের অভিযোগ করেছেন, তা লিখিত ভাবে দলীয় নেতৃত্বকে জানানোর জন্য বিধায়ককে নির্দেশ দিয়েছেন পার্থবাবু। কিছু দিন আগেই প্রকাশ্যে পরস্পরের দিকে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় প্রবীণ সাংসদ শিশির অধিকারী এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলারই বিধায়ক অখিল গিরিকে সতর্ক করেছিলেন পার্থবাবু। তপনবাবুর ক্ষেত্রেও ক্ষুব্ধ পার্থবাবুর বক্তব্য, “আমরা বলেছি, দলের বিষয়ে কিছু অভিযোগ বা বলার থাকলে তা দলের মধ্যেই বলতে হবে। দলকে প্রকাশ্যে হেয় করে হিরো সাজা আমরা বরদাস্ত করব না!”

কিন্তু তপনবাবু তো দাবি করছেন, তথ্য-সহ অভিযোগ তিনি শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন। তখন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেন? স্পষ্ট জবাব এড়িয়েই পার্থবাবু বলেছেন, “আমাদের দল কোনও অবস্থায় কোনও আর্থিক বেনিয়মে ছিল না, নেই এবং থাকবে না!”

যে নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ এনেছেন তপনবাবু, বর্ধমান জেলা পরিষদ সদস্য সেই বিপুল দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাদ দীর্ঘ দিনের। তৃণমূল সূত্রের খবর, গত ১১ অক্টোবর বিপুলবাবু ও তাঁর অনুগামীরা তৃণমূলের নামে একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন। তপনবাবুর দাবি, কিছু ব্যবসায়ী তাঁর কাছে অভিযোগ করেন, ওই শিবিরের নামে তোলাবাজি চলছে। তাঁরা বিধায়কের হাতে শিবিরের একটি কার্ড দেন। তাতে সাদা খামের মধ্যে একটি বিল থাকলেও তাতে টাকার অঙ্ক বা আদায়কারীর সই ছিল না। কিন্তু খামের উপরে টাকার অঙ্ক লিখে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূল সূত্রের খবর, বহরা গ্রামের এক লগ্নি সংস্থার এজেন্ট তপনবাবুর কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর কাছে অনুষ্ঠানের জন্য তিনশো ঘড়ি চাওয়া হয়েছে।

তপনবাবুর দাবি, ওই রক্তদান শিবির হওয়ার আগেই তিনি কলকাতায় শীর্ষ নেতাদের ফোন করেছিলেন। এর পরে ১৯ অক্টোবর মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রামের অনুষ্ঠানে কারও নাম না করে তপনবাবু বলেন, “কিছু লোকজন নির্লজ্জের মতো কাজ করছেন! সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের নাম করে ইটভাটা থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। বিলে ব্যবসায়ীর নাম লেখা হলেও টাকার অঙ্ক লেখা হচ্ছে না, আদায়কারীর সইও থাকছে না।”

তৃণমূলের মধ্যে থেকেই দলের নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ ওঠা অবশ্য এই প্রথম নয়। লোকসভা ভোটের পরপরই নদিয়ার একটি সভায় দলের লোকজনদের তোলাবাজি ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নিয়ে মুখ খুলেছিলেন স্বয়ং মুকুল রায়ের বিধায়ক-পুত্র শুভ্রাংশু। কয়েক মাস আগেই দুর্গাপুর পূর্বের বিধায়ক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় শীর্ষ নেতৃত্ব ও পুলিশের কাছে দলের এক নেতার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানো ও তোলাবাজির অভিযোগ করেন। তখন কেউ গা করেননি। পরে ওই নেতা অন্য একটি প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হলে মাস তিনেক বাদে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তৃণমূল সূত্রের খবর, তপনবাবু শীর্ষ নেতৃত্বকে যখন বিষয়টি প্রথম জানান, তখন তাঁকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলা হয়নি। অথচ এ দিন পার্থবাবু ফোন করে জানতে চেয়েছেন, লিখিত ভাবে দলকে না জানিয়ে তিনি কেন সংবাদমাধ্যমে এ সব বলতে গিয়েছেন? তপনবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, পার্থবাবুকে বিধায়ক জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমকে তিনি কিছুই বলেননি। যা বলার, দলের কর্মিসভায় বলেছেন। দল নির্দেশ দিলে অভিযোগপত্রও পাঠিয়ে দেবেন। তপনবাবু এ দিন বলেন, “আমি দলের কাছে বিশদ রিপোর্ট দিয়েছি।”

কী ভাবে তোলাবাজি চলছে? বিধায়কের বক্তব্য, “বাড়িতে বসেই ফোনে খবর পেলাম, এলাকার একটি পাম্প থেকে আমার নাম করে ৫০ লিটার পেট্রোল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জানতে পারি, আমার নাম ভাঙিয়ে জেলা পরিষদের এক দাঁত উঁচু নেতা (পড়ুন, বিপুল দাস) ওই তেল নিয়ে পালিয়েছে!” বিপুলবাবুর নাম না-করেও তাঁর অভিযোগ, “ওই নেতা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জ্বালায় এলাকার বহু ব্যবসায়ী অতিষ্ঠ। তাঁরা বারবার আমায় ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন। দল চাইলে তাঁদের কথা শুনতে পারে।”

বিপুলবাবু এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “যা বলার দলের নেতারাই বলবেন।” যে অনুষ্ঠানে ওই অভিযোগ তুলেছিলেন তপনবাবু, সেখানে ছিলেন তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি তথা রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও। তিনি বলেন, “কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার যদি অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, তবে দলের নামে কুৎসা ছড়ানোর জন্য অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মন্তব্য করেছেন, “কিছু দিন আগে সাংসদ শিশির অধিকারী এবং তারও এক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী নিজে দলের নেতাদের তোলাবাজির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। বিধায়কের কথাতেই প্রমাণ, তার পরেও তোলাবাজি, দুর্নীতি থামেনি।” আর কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রী বলছেন মদন-মুকুলকে চক্রান্ত করে চোর বলা হচ্ছে। তাঁর দলেরই বিধায়ক বা যাঁরা এমন অভিযোগ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কি চক্রান্তের দায়ে ব্যবস্থা নেবেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE