সংস্কার: ডাইনি অপবাদে লাঞ্ছনার ঘটনার পর গ্রামবাসীদের বোঝাচ্ছেন প্রশাসনের কর্তারা। বর্ধমানের কাঁকসায়। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র।
পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ বলছে, নিয়মিত সচেতনতা বাড়ানোর প্রচার চলছে। তার পরও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের তরফ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা অনেকাংশেই মিলছে না তার সঙ্গে। সম্প্রতি এ রাজ্যে একাধিক ‘ডাইনি’ নির্যাতনের ঘটনায় পঞ্চায়েত, পুলিশ কিংবা প্রশাসনের সামান্য সহায়তাও আক্রান্তরা পাননি বলে অভিযোগ। খোদ রাজ্য মহিলা কমিশনই সে কথা স্বীকার করছে।
কী রকম? কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় পরিসংখ্যান তুলে ধরে বললেন, ‘‘২০১৬ সালে ৩৫টি এবং চলতি বছরে ইতিমধ্যেই ৫টি অভিযোগ পেয়েছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অত্যাচারের পর প্রশাসন কোনও মহিলা কিংবা পরিবারকে গ্রামে ফেরাতে পারেনি।’’ বীরভূম, বর্ধমানের মতো জেলায় ডাইনি নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে বলেই লক্ষ করছে কমিশন।
যেমন বীরভূমের মহম্মদ বাজারের কানাদীঘি গ্রামের ঘটনা। ১ মে ওই গ্রামের লোকজন সরস্বতী টুডু নামে বছর ষাটের এক প্রৌঢ়ার উপরে চড়াও হয়। অভিযোগ, গ্রামের মনসা পুজোর ঘটটি সরস্বতী চুরি করেছেন। তিনি ‘ডাইনি।’ ওই প্রৌঢ়াকে উলঙ্গ করে মারধর করার অভিযোগ ওঠে গ্রামবাসীদের একাংশের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর থেকে প্রশাসন এখনও পর্যন্ত সরস্বতীকে বাড়িতে ফেরাতে পারেনি। তিনি মেয়ের বাড়িতে গিয়ে রয়েছেন। ঘরছাড়া তাঁর ছেলে-বৌমা এবং নাতি-নাতনিও।
২৬ এপ্রিল রূপপুরের বাসিন্দা কালোমনি সোরেনকে কুড়ুল দিয়ে কোপ মারেন তাঁর আত্মীয়েরাই। কেন? পরিবারে এক কিশোর সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে। পরিবারের একাংশের অভিযোগ, কালোমনিই সাপ হয়ে ওই ছেলেটিকে কামড়েছেন।
আরও পড়ুন: কোথায় স্বজন, দিশাহারা শহর
বিনোদপুরের কিসকু পরিবার। কোনও পরিবারে চার জন মেয়ে থাকা মানেই পরিবারটি ‘ডাইনি’। তাই এমন মারধর করা হল যে এক বৃদ্ধা মারা গেলেন। বাকি মেয়েদের আধমরা করে ফেলে রেখে গেল গ্রামবাসীরা। ২০১৫ সালের এই ঘটনার পর থেকে পরিবারটিকে এখনও বয়কট করে রেখেছে গোটা গ্রাম।
কেন তৎপর হচ্ছে না পুলিশ? বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহনগাঁধী দাবি করছেন, ‘‘আমরা অভিযোগ দায়ের করেছি। তবে এই ধরনের অপরাধ শুধু আইন দিয়ে বন্ধ করা যায় না। সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে।’’ একই দাবি বীরভূমের পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমারেরও। গ্রামের মোড়লরাও বলছেন, কুসংস্কারের বশেই গুনিন দিয়ে যাচাই করে কোনও পরিবারের মহিলা কিংবা মেয়েকে ‘ডাইনি’ বলে চিহ্নিত করা হয়। সচেতনতা বাড়ালে এটা বন্ধ করা সম্ভব।
কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ এবং জেলা প্রশাসনের একাংশ স্বীকার করছেন, বিষয়টা শুধু কুসংস্কারের নয়। বরং কুসংস্কারকে সামনে রেখে রাজনৈতিক এবং সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্য কাজ করছে। বেশির ভাগ ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি সংক্রান্ত বিবাদ। এবং বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ, আদিবাসী সমাজকে চটাতে চায় না বলেই পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পঞ্চায়েত-আধিকারিকের কথায়, ‘‘পাথর খাদান, কয়লা খাদানের ব্যবসা চালাতে গেলে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়কে চটালে ক্ষতি হবে। এই ভেবে কেউ পদক্ষেপ করে না।’’
তবে কি এই রকমই চলবে? রাজ্যের নারীকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা আশ্বাস দিচ্ছেন, সরকার চুপ করে থাকবে না। যে সব জেলায় এ রকম ঘটনা বেশি ঘটছে, সেগুলি চিহ্নিত করে নারীকল্যাণ দফতর আলাদা করে সচেতনতার প্রচাব করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy