সার দিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায়। —নিজস্ব চিত্র।
বছরখানেক আগে যখন প্রায় নিঃশব্দে ই-রিকশা রাস্তায় নেমে এসেছিল, তখন হিসেব-নিকেশের চেয়ে লোকের কৌতূহলটাই ছিল বেশি। গত প্রায় এক বছরে দ্রুত রাজ্যের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ই-রিকশা ওরফে টোটো ওরফে টুকটুকই কারও স্বস্তি কারও বিরক্তি, এমনকী রাগেরও কারণ হয়ে উঠেছে।
টোটো পথে নামায় শহর-গঞ্জের বাসিন্দারা প্রথমত যে কারণে স্বস্তি পেয়েছিলেন, তা হল রিকশা বা অটো চালদের রোয়াব আর সইতে হবে না। টোটোওয়ালারা তখন জামাই-আদর করে সওয়ারি তুলছিলেন। রিকশার তুলনায় টোটোর ভাড়া কম, গতি বেশি। রিকশায় যে দূরত্ব যেতে ২০-৩০ টাকা ভাড়া দিতে হয়, সেখানে টোটো নেয় মোটে ১০ টাকা।
অটোর তুলনায় টোটোর গতি কম ঠিকই, তবে অল্প দূরত্বে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তাতে তেমন ফারাক হয় না। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের বাসিন্দা নারায়ণ দাসের অভিজ্ঞতা: ‘‘আগে চর শঙ্করআড়া থেকে হাসপাতাল মোড় যেতে রিকশা ২০ টাকা নিত। টোটোয় যেতে লাগে ১০ টাকা। যাতায়াতটাও অনেক আরামপ্রদ।’’ শহরের টোটো চালক মানিক মাইতির মতে, ‘‘এখন রিকশার বদলে লোকে টোটোতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আমাদের যাত্রীও বেড়েছে অনেক বেশি।’’
আর ঠিক সেই কারণেই রিকশা এবং অটো চালকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে ব্যাটারিচালিত এই নতুন গাড়ি। হাওড়ার বালি থেকে হুগলির শ্রীরামপুর— বহু জায়গাতেই দু’পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তার কারণও আছে। অটো সাধারণত চলে তুলনামূলক বড় রাস্তায়, রিকশা এলাকার ভিতরে অলিতে-গলিতে। কিন্তু গোড়া থেকেই বড়-ছোট দুই রাস্তাতেই টোটো চলতে শুরু করে। ভাত মারা যায় রিকশা ও অটো চালকদের। বাধ্য হয়ে এঁদের অনেকে ইতিমধ্যেই অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। যাঁরা এখনও মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তাঁরা মারমুখী।
বর্ধমান শহরে টোটো চলাচল শুরু হয় মাস চারেক আগে। গোড়া থেকেই তা নিয়ে রিকশা চালকদের আপত্তি ছিল। বেশ কয়েক বার তাঁরা থানায় বিক্ষোভও দেখান। শহরের রিকশা ইউনিয়নের নেতা সন্তোষ শিকদারের আক্ষেপ, ‘‘টোটোর ভাড়া কম হওয়ায় আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’’ শেখ পিন্টু নামে এক রিকশাচালক বলেন, ‘‘রোজগার তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে।’’ তমলুকের রিকশা চালক রুহুল ইসলামেরও অভিজ্ঞতা একই— ‘‘আগে দিনে আড়াইশো-তিনশো টাকা রোজগার করতাম। এখন তা একশো টাকায় দাঁড়িয়েছে।’’ বীরভূমে জেলাসদর সিউড়ির অবস্থাও প্রায় একই।
নদিয়ার রানাঘাট শহরে মাত্র সাত মাসে টুকটুকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩৫টিতে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এমন অবস্থা যে সেখানকার রিকশা চালক ইউনিয়ন সমিতির সভাপতি শান্তিপদ দত্ত নিজেই এখন রিকশা ছেড়ে টুকটুক চালাচ্ছেন। তাঁর কথায়, তিনি বলেন, ‘‘কী করব? রিকশার কোণঠাসা অবস্থা। শহরের মানুষ আর বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশা চড়তে চাইছেন না।” ধাক্কা লেগেছে চালু অটো রুটেও। আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট অটো অপারেটর্স ইউনিয়নের সদস্য বুদ্ধদেব ঘোষ বলেন, “গাড়ি নিয়ে বের হলেই আগে ছ’শো টাকা রোজগার ছিল। এখন সারা দিনে ২০০ টাকার বেশি হচ্ছে না। অনেকে অটো চালানো ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।’’
টোটো নিয়ে যে অভিযোগটিকে বড় করে তুলে ধরতে চাইছেন রিকশা ও অটো চালকেরা, তা হল টোটোর লাইসেন্স এলবং বিমা না থাকা। সব পুর এলাকাতেই রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়। যদিও সর্বত্রই লাইসেন্স ছাড়াও বেশ কিছু রিকশা চলে। অটো চালানোর জন্য লাইসেন্স তো লাগেই, বিমাও করাতে হয়। কিন্তু টোটোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে লাইসেন্স দেওয়া প্রায় কোনও পুরসভাই চালু করেনি। বিমার তো প্রশ্নই নেই। নির্দিষ্ট রুটও নেই। ফলে যেখানে সেখানে যথেচ্ছ সংখ্যায় টোটো রাস্তায় নেমে পড়ছে, কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বিমা না থাকা সত্ত্বেও বাস-অটো চলার রাস্তায় চলাচল করছে টোটো। যাত্রী-সুরক্ষার বালাই নেই।
বর্ধমানে যেমন মাসখানেক আগে ৭৫টি টোটোকে লাইসেন্স দিয়েছিল পুরসভা। তাদের পরিবহণ দফতরের থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার বাইরেও হাজারখানেক টোটো চলছে। তমলুকে টোটো চালকরা লাইসেন্স চেয়ে পুরসভায় আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এখনও সে ব্যাপারে কিছু হয়নি। রানাঘাট পুরসভা বাইরে থেকে শহরে ঢোকা টোটোর থেকে অন্য গাড়ির মতোই দিনে ১০ টাকা টোল ট্যাক্স নেয়, কিন্তু লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি। মুর্শিদাবাদে বহরমপুর পুরসভা গাড়ি প্রতি ৩০০ টাকা লাইসেন্স ফি এবং রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১৫০০ টাকা করে নিচ্ছে। কিন্তু কত গাি ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে পড়েছে, তার কোনও পরিসংখ্যান পুর কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
এর ফলে উপকারের বদলে ক্রমশ উৎপাত বাড়ছে বলে শুধু রিকশা বা অটো চালকেরা নন, নাগরিকদেরও অনেকে এখন মনে করতে শুরু করেছেন। কারণ— ১) রাতারাতি ঝাঁকে-ঝাঁকে টোটো রাস্তায় নেমে পড়ায় ছোট শহরের রাস্তায় যানজট হচ্ছে। ২) বাস রাস্তায় চলার তুলনায় টোটোর গতি খুবই কম। ফলে বাস এবং অটো বারবার টোটোর পিছনে আটকে পড়ছে, ট্রাফিক মন্থর হয়ে যাচ্ছে। ৩) প্রচুর টোটো রাস্তায় নামায় এখন নিজেদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্ষতি পোষাতে সুযোগ পেলেই বেশি ভাড়া নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে কিছু টোটো চালকের বিরুদ্ধে। ৪) পায়ের তলায় মাটি পেয়ে যেতেই টোটো চালকদের অনেকে এখন যাত্রীদের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, যা কিছু দিন আগেও রিকশা বা অটো চালকদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের প্রধান অভিযোগ ছিল। ৫) সরকারি কোনও নম্বর না থাকায় কোনও যাত্রী টোটোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও সমস্যায় পড়ছে পুলিশ।
টোটো চলায় অনেক জায়গাতেই যাত্রীদের যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে ঠিকই। যেমন, বর্ধমান শহরে তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আলিশা পর্যন্ত টোটো চলাচল করায় কাছাকাছি যাতায়াত আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। কিন্তু তুলনায় ছোট শহরগুলিতে অন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে। নদিয়ার প্রাচীন শহর নবদ্বীপের রাস্তাঘাট এমনিতেই সরু। পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় বারোমাস দর্শনার্থীদের ভিড়ও লেগে থাকে। এত দিন শুধু রিকশাতেই যানজট হয়ে যেত। সেখানে এক বছরের মধ্যে সাতশোরও বেশি টোটো নেমে পড়ায় পরিবহণ ব্যবস্থা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। ইচ্ছে মতো রুটে যাওয়া, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে পড়া, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও উঠছে। সিউড়ির মূল রাস্তায় যে হারে টোটো বাড়ছে, তাতে গাড়ি-বাস চলাচলও মন্থর হয়ে পড়ছে। রানাঘাটের বাসিন্দা মোহন ঘোষও বলেন, ‘‘টুকটুকের কারণে শহরে যানজট হচ্ছে। বিষয়টি পুরসভার দেখা উচিত।’’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পরে গত অক্টোবর থেকে ই-রিকশার নথিভুক্তি এবং অনুমোদনের জন্য তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গোটা বিষয়টি সম্পন্ন হলে সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে। তার পরেও কিছু সমস্যা হয়তো থেকে যাবে। যেমন, শুধু নিয়ম দিয়ে তো দুর্ব্যবহার বন্ধ আটকানো যায় না। পেটের দায়ে মরিয়া রিকশা বা অটো চালকদের সঙ্গে টোটো-বাহিনীর সংঘাতও এখনই থামার নয়।
কিন্তু প্রশাসন নজর রাখলে নিয়ম ভেঙে বড় রাস্তায় টোটোর উঠে পড়া, যানজট, যাত্রী-হেনস্থা কমতে বাধ্য। সেটাই বা কম কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy