Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ছুটছে ওরা, ভরসা কু ঝিকঝিক কাকুদের

খাতায়-কলমে ওঁরা লোকো পাইলট। আর এখন ড্রাইভার কাকু।প্রত্যেকেই পঞ্চাশোর্ধ্ব। জীবনের অনেকটা কেটে গিয়েছে ট্রেন চালিয়ে। দিন নেই, রাত নেই, ছুটে বেড়াতে হয় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ। একটা সময়ে এসে মনে হয়েছে জীবনে সত্যিই কি অর্থবহ কিছু করা হল!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

খাতায়-কলমে ওঁরা লোকো পাইলট। আর এখন ড্রাইভার কাকু।

প্রত্যেকেই পঞ্চাশোর্ধ্ব। জীবনের অনেকটা কেটে গিয়েছে ট্রেন চালিয়ে। দিন নেই, রাত নেই, ছুটে বেড়াতে হয় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ। একটা সময়ে এসে মনে হয়েছে জীবনে সত্যিই কি অর্থবহ কিছু করা হল! এই ভাবনা থেকেই নিজেদের পেশার বাইরে অন্য পথের খোঁজ শুরু। মেধাবী অথচ হতদরিদ্র— এমন কিছু দিশাহারা জীবনকে ‘অর্থবহ’ করে তুলতে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছেন পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের ১২১ জন ট্রেনচালক।

কাজ শুরু বছর খানেক আগে। ছুটির দিনটা পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে দুঃস্থ ও মেধাবী পড়ুয়াদের খোঁজে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়া। সেই অভ্যেসে কোনও ছেদ পড়েনি। এখন অন্তত ৪৫০ পড়ুয়ার কাছে এই ড্রাইভারকাকুরাই সব।

কী ভাবে মেধাবীদের বেছে নেওয়া হচ্ছে?

প্রাথমিক ভাবে দেখা হচ্ছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় কোথায় কোন পড়ুয়া ভাল রেজাল্ট করেছে এবং তার পারিবারিক আয় কত। তার পরে বিভিন্ন গ্রামের সম্ভাবনাময় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ড্রাইভারকাকুদের থেকে মাসে এক হাজার টাকা করে ‘ভাতা’ পাচ্ছে অন্তত ৫০ জন। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি ছাড়াও ২০০ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর জন্য কাকুরা চালু করেছেন অবৈতনিক কোচিং সেন্টার। সেখানেই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে বারাসতের দু’টি অনাথ আশ্রমের আরও ২০০ জন ছাত্রছাত্রী। এই ভাবে বর্ধমানে নারুগ্রামের রাহুল কর্মকার, ওন্দা নিকুঞ্জপুর হাইস্কুলের তানিয়া শিট, শ্যামসুন্দর রামলাল আদর্শ বিদ্যালয়ের বিদিশা ঘোষের মতো বহু কিশোর-কিশোরী কাকুদের পাশে পেয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কেউ টাকা পেয়ে বই-খাতা কিনে ফেলছে। অনেকে আবার স্কুলে যাতায়াতের খরচ মেটাচ্ছে।

এমনই এক জন তানিয়া। ওন্দা-র খেমুয়া গ্রামের এই মেয়ে চলতি বছরে মাধ্যমিকের সব বিষয়েই ৯০-এর ঘরে নম্বর পেয়েছে। অঙ্ক-পদার্থবিজ্ঞানে তো ১০০-তে ১০০, জীবন বিজ্ঞানে ৯৯। এমন ভাল ফল নিয়ে প্রশ্ন করতেই শীর্ণ মেয়ে বলল, ‘‘বাবা ভাগচাষ করেন। অসুস্থ। পড়া বন্ধই হয়ে যেত। ড্রাইভারকাকুদের পেয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।’’

ট্রেন চালকদের এমন অভিনব উদ্যোগ দেখে এগিয়ে এসেছেন হিন্দু, হেয়ার, টাকি, ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের কয়েক জন মাস্টারমশাই। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির যে ছেলেমেয়েরা ভাতা পাচ্ছে, তাদের তিন মাস অন্তর কলকাতায় এনে বিশেষ কোচিং করাচ্ছেন ওই মাস্টারমশাইরা। কোন বিষয় কেমন ভাবে পড়তে হবে, কতটুকু লিখতে হবে— শেখাচ্ছেন হাতে-কলমে। টাকি স্কুলে তাদের একটি পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, ছাত্রছাত্রীদের কতটা উন্নতি হচ্ছে, তা পরখ করা। উৎসাহ পেয়ে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরের বাচ্চাদের জন্যও একটি কোচিং সেন্টার খুলতে চেয়ে রেলের ডিভিশনাল ম্যানেজারের কাছে চিঠি দিয়েছেন চালকেরা। জবাব এখনও মেলেনি। তবে কাকুরা হাল ছাড়ছেন না। আর এই কাজ নিয়ে খুব একটা হইচইও চান না তাঁরা।

কিন্তু কী ভাবে টাকার জোগাড় করছেন?

প্রশ্ন শুনে হাসছেন অসীমরঞ্জন কুণ্ডু, উজ্জ্বল সরকার, অমিতাভ চক্রবর্তী, সুমিত ভট্টাচার্য, রানা সেনগুপ্তদের মতো শিয়ালদহ স্টেশনের পরিচিত মুখগুলো। ‘‘প্রতি মাসের বেতনের একটি অংশ দিয়ে আমরা তহবিল তৈরি করেছি। সেই টাকাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কাজে লাগছে,’’ বললেন ওঁরা। আরও বললেন, ‘‘শুধু টাকা জমালাম আর নিজের সংসার গোছালাম, এতটা স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করল না। ভাবলাম, অনেকটা পেরিয়ে এসেছি। এ বার একটু চেষ্টা করে দেখা যাক।’’

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর এই কারবারে প্রথম দিকে ওঁদের কয়েক জনের বাড়ি থেকে আপত্তি ওঠে। অনেকে এই ‘মূর্খামি’ বন্ধ করার করতে পরামর্শও দিয়েছেন। ‘‘এখন অবশ্য সেই মুখগুলোতেই সমীহের ছাপ’’, বলছেন লোকো পাইলট থুড়ি ড্রাইভার কাকুরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

train drivers social work
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE