Advertisement
E-Paper

পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধে চলল গুলি, অগ্নিগর্ভ ভাঙড়ে হত ২

গ্রামবাসীদের সম্মতি না-থাকলে ভাঙড়ে ‘পাওয়ার গ্রিড’ করা হবে না বলে সোমবারই ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তাতেও শান্ত করা গেল না বিক্ষোভকারীদের। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে মঙ্গলবার রণক্ষেত্র হয়ে উঠল ভাঙড়। যার জেরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন দুই গ্রামবাসী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৩
গুলিবিদ্ধ বিক্ষোভকারী আলম মোল্লা।

গুলিবিদ্ধ বিক্ষোভকারী আলম মোল্লা।

গ্রামবাসীদের সম্মতি না-থাকলে ভাঙড়ে ‘পাওয়ার গ্রিড’ করা হবে না বলে সোমবারই ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তাতেও শান্ত করা গেল না বিক্ষোভকারীদের। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে মঙ্গলবার রণক্ষেত্র হয়ে উঠল ভাঙড়। যার জেরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন দুই গ্রামবাসী। পাল্টা মার খেল পুলিশও। তাদের প্রায় ৪০টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩০ জন পুলিশকর্মী। তাঁদের মধ্যে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে প্রশাসনিক সূত্রে দাবি। এলাকায় প্রচুর পুলিশ, কমব্যাট ফোর্স ও র‌্যাফ মোতায়েন করা হলেও রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পুলিশ জানিয়েছে, এলাকার বিভিন্ন জায়গার গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছেন বিক্ষোভকারীরা।

গুলিতে যে দুই গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের এক জনের নাম আলম মোল্লা (২২)। কাশীপুরের স্বরূপনগরের বাসিন্দা আলম স্থানীয় ডিরোজিও কলেজের ছাত্র ছিলেন। অন্য জন কাশীপুরেরই বকুলতলার বাসিন্দা মফিজুল খান (২৬)। পুলিশের গুলিতেই এঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। যদিও এ দিন রাতেই রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা দাবি করেন, বহিরাগতদের ছোড়া গুলিতেই এই দু’জন মারা গিয়েছেন।

এ দিন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনা নিয়ে বৈঠক করেন। পরে সরকারি ভাবে জানানো হয়, (১) পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প স্থগিত রাখা হল। (২) এলাকার কৃষি জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। (৩) পুলিশকে আরও বেশি সংযত থাকতে হবে। প্রশাসনের কর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভাঙড়ের বিধায়ক তথা খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাকে এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দিয়ে‌ছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিকেলে ভাঙড়ের দক্ষিণ গাজিপুরে যান রেজ্জাক। সেখানে গ্রামবাসীদের তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে রেজ্জাক বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে।’’

জনতার আক্রোশে জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। মঙ্গলবার ভাঙড়ে সামসুল হুদার তোলা ছবি।

পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় জমিরক্ষা কমিটির দুই সদস্যকে আটক করে সিআইডি গোয়েন্দারা নিউ টাউন থানা নিয়ে আসেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ-আন্দোলন। জমিরক্ষা কমিটির সদস্যরা হাড়োয়া-লাউহাটি রোড অবরোধ করেন। ভাঙড়ের টোনা, বাদামতলা, খামারহাটি-সহ বিভিন্ন এলাকাতেও গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা আটকানো হয়। রাতে পুলিশ বাহিনী অবরোধ হঠাতে গিয়েছিল। তখন মারমুখী হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। একের পর এক পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মারধর করা হয় পুলিশকর্মীদের। রাতে আরও পুলিশ গিয়ে ছ’জন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, ওই সময়ে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে অত্যাচার চালায়। মারধর করা হয় মহিলাদেরও।

মঙ্গলবার সকালে এলাকায় সে কথা ছড়িয়ে পড়তে ক্ষিপ্ত বিক্ষোভকারীরা আরও নতুন নতুন এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে শুরু হয়ে যায় খণ্ডযুদ্ধ। তখন ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) ভরতলাল মিনা বাহিনী নিয়ে এলাকায় যান। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর পর উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিলিত পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। নামানো হয় কমব্যাট ফোর্স ও র‌্যাফ। বিক্ষোভকারীরাও লাঠি, ইট নিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। কয়েক জায়গায় বোমাবাজিরও অভিযোগ ওঠে। গ্রামের ভিতরে পুলিশের গাড়ির উপর হামলা চালানো হয়। গুরুতর আহত হন দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

কেন এ ভাবে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল ভাঙড়?

ভাঙড়-২ ব্লকের ভূমি রাজস্ব আধিকারিক নবান্নে পাঠানো রিপোর্টে জানিয়েছেন, পাওয়ার গ্রিডের সাব-স্টেশনের আশপাশের জমি তিনটি আবাসন প্রকল্পের জন্য কেনা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে ওই জমি কেনা হলেও কৃষি থেকে বাস্তু জমিতে এখনও তা রূপান্তরিত করা হয়নি। সে জন্য ভূমি রাজস্ব আধিকারিকের উপর চাপ রয়েছে। রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগও নবান্নকে জানিয়েছে, হাই টেনশন লাইন টানার জন্য যে খুঁটি পোঁতা হবে, তা আবাসন প্রকল্পগুলির মধ্য দিয়েও যাবে। ফলে, ওই জমিতে বহুতল তৈরি করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সেই কারণে জমি আন্দোলনের পিছনে প্রোমোটারদেরও নেপথ্য ভূমিকা থাকতে পারে।

এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে নবান্নের এক শীর্ষকর্তা এ দিন বলেন, ‘‘আবাসন প্রকল্পের জন্যই যখন এত গোলমাল, তখন ওখানে কোনও আবাসনই হবে না। এই কারণেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাঙড় এলাকায় চাষের জমির চরিত্র বদল হবে না। এর ফলে আবাসন প্রকল্পগুলি সব বাতিল হবে। যাঁরা চড়া দামে জমি কিনেছেন, তাঁদেরও চাষবাসই করতে হবে।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘এক শ্রেণির অশুভ সংস্থা, যারা বাড়ি তৈরি করে, তারা আগে থেকেই বেনামে জমি কিনে রেখেছিল। কৃষিজমির চরিত্র বদল করে ফেলেছে তারা। কৃষিজমি চরিত্র বদল হোক, আমরা চাই না।’’

তবে, আবাসন প্রকল্পে অনিশ্চয়তার কারণে ইন্ধনের পাশাপাশি এলাকার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমীকরণকেও গোলমালের জন্য দায়ী করছে প্রশাসনের একাংশ। রাজ্যের গোয়েন্দা শাখার (আইবি) এক কর্তার কথায়, অসন্তোষের খবর পেয়ে নকশালদের একাংশ এলাকায় সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করে দেয়। সিপিএম থেকে তৃণমূলে আসা রেজ্জাক মোল্লাকে কোণঠাসা করার জন্য শাসক দলের বেশ কয়েক জন নেতাও হাত মেলান তাদের সঙ্গে। সঙ্গী করা হয় কয়েকজন বাম নেতাকেও। এলাকায় প্রচার করা হয়, পাওয়ার গ্রিড চালু হলে মানুষজন অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারাবেন। এ ভাবেই তৈরি এই জঙ্গি আন্দোলনের ভিত। এক গোয়েন্দা কর্তা জানান, তিন বছর আগে জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়। পাওয়ার গ্রিডের কাজও অনেকটা এগিয়েছে। এত দিন সমস্যা হয়নি। আন্দোলনকারীরা এখন রেজ্জাক-বিরোধী তৃণমূল নেতাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছেন।

জমি বাঁচানোর নামে আন্দোলনের উপরে বোমা-গুলি-লাঠির ঘটনাকে হাতিয়ার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পাল্টা সওয়াল করার সুযোগ পেয়েছে বিরোধীরা। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম যেমন বলেছেন, ‘‘যিনি ভূমিরক্ষা কমিটি গড়েছিলেন, তাঁর সরকার এখন কী করছে?’’ একই প্রশ্ন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর। আর বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘‘ভাঙড়ে গরিব মানুষের উপরে লাঠি-গুলি চালানো মমতার সরকারের ওয়াটারলু হবে!’’ বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহের অবশ্য দাবি, ‘‘ভাঙড়ের ঘটনা তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল।’’

Two Killed Bhangar Protest Power Grid
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy