Advertisement
০৬ মে ২০২৪
অভিন্ন প্রবেশিকা সারা দেশে

রাজ্য মেডিক্যাল জয়েন্ট বাতিল, অথৈ জলে বাংলার ৮৫ হাজার পরীক্ষার্থী

এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে দিনরাত এক করে প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এন্ট্রান্স-বৈতরণী পেরোলেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের চৌকাঠ ডিঙোনো যাবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৭
Share: Save:

এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে দিনরাত এক করে প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এন্ট্রান্স-বৈতরণী পেরোলেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের চৌকাঠ ডিঙোনো যাবে। কিন্তু আচমকা এক নির্দেশেই ঘোর সঙ্কটে রাজ্যের ৮৫ হাজার মেডিক্যাল-জয়েন্ট পরীক্ষার্থী। অন্য কারও কাছ থেকে নয়। নির্দেশটা এসেছে সরাসরি সুপ্রিম কোর্ট থেকে।

রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের নেওয়া যে-পরীক্ষা পাশ করলে এত দিন এখানকার সব মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া যেত, এ বার সেই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৭ মে। কিন্তু সেই জয়েন্টের মেডিক্যাল অংশটাই যে আর থাকছে না! সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশে জানিয়ে দিয়েছে, দেশের সব মেডিক্যাল কলেজে পড়ার জন্য মাত্র একটিই প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকবে। বিভিন্ন রাজ্য আলাদা করে যে-সব মেডিক্যাল জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেয়, সেগুলোর কোনওটাই আর থাকবে না। শুধু সরকারি মেডিক্যাল নয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও ছাত্র ভর্তি করতে হবে কেন্দ্রীয় ভাবে নেওয়া একমাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমেই। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই নির্দেশ বলবৎ করতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।

রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের তরফে জানানো হয়েছে, যাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসবেন, তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। ১৭ মে তাঁরা পূর্বনির্ধারিত সূচি মেনেই পরীক্ষা দেবেন। তবে যাঁরা রাজ্যের মেডিক্যাল জয়েন্ট দেবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন, তাঁদের কেন্দ্রীয় ভাবে নেওয়া জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাতেই বসতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বাইরে গিয়ে বোর্ডের কিছু করার নেই। ওই বোর্ডের চেয়ারম্যান সজল দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। যা বলার স্বাস্থ্য দফতর বলবে।’’ আর রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের তরফে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফ কথা, আদালতের নির্দেশ যখন রয়েছে, ব্যবস্থা তো করতেই হবে।

রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার আর মাত্র ১৮ দিন বাকি। একেবারে শেষ মুহূর্তে এই নির্দেশ যে পরীক্ষার্থীদের মনের উপরে ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করবে, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। নিজেদের অসহায়তা কবুল করে এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘আমরা নিরুপায়।’’

ডাক্তারি পাঠ্যক্রমে ভর্তির জন্য যে-সর্বভারতীয় পরীক্ষা নেওয়া হয়, এ বার সেটি হচ্ছে দু’দফায়। প্রথমটি অল ইন্ডিয়া প্রি-মেডিক্যাল টেস্ট (এআইপিএমটি) হবে কাল, রবিবার, ১ মে। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট (এনইইটি) হওয়ার কথা ২৪ জুলাই। যে-পঁচাশি হাজার পরীক্ষার্থীর এ রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের নেওয়া মেডিক্যাল জয়েন্টে বসার কথা ছিল, তাঁদের একটা অংশ প্রথম পরীক্ষা অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া প্রি-মেডিক্যাল টেস্টে বসছেন। কিন্তু অনেকে তো ওই পরীক্ষার ফর্মই পূরণ করেননি। তাঁরা কী করবেন?

রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড সূত্রে জানানো হয়েছে, ২৪ জুলাই যে-প্রবেশিকা পরীক্ষা (এনইইটি) হবে, তার জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হবে ২১ মে থেকে ২০ জুন পর্যন্ত। ফলে যাঁরা রবিবারের প্রি-মেডিক্যাল জয়েন্টে বসছেন না, তাঁরা চাইলে এনইইটি-র জন্য ফর্ম পূরণ করতে পারবেন। দু’টি পরীক্ষারই ফল বেরোনোর কথা ১৭ অগস্ট।

কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটবে না বলে শিক্ষা শিবিরের অভিমত। রাজ্যের জয়েন্ট বোর্ড সূত্রের খবর, এনইইটি-র পাঠ্যক্রম এবং এই রাজ্যে জয়েন্টের পাঠ্যক্রমের মধ্যে ফারাক অনেকটাই। এ রাজ্যে দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই জয়েন্টের প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। সে-ক্ষেত্রে হঠাত্ ওই মূল পরীক্ষায় বসতে হলে পাঠ্যক্রম নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারেন পরীক্ষার্থীরা।

শুধু তা-ই নয়, মূল পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যার কথাও উঠছে। এ রাজ্যের জয়েন্টে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। তাই দেশ জুড়ে একটিই মেডিক্যাল জয়েন্ট পরীক্ষা হলে ভাষাগত সমস্যা হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের পরীক্ষার্থীদের। বোর্ডের একাংশ বলছেন, যে-সব রাজ্যের নিজস্ব জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড আছে, তাদের ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে অন্তত এক বছর সময় দেওয়া উচিত ছিল। আগামী বছর থেকে অভিন্ন মেডিক্যাল জয়েন্ট চালু করা যেতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে না।

এই অবস্থায় রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের যে কিছু করার নেই, তা ঠারেঠোরে জানিয়ে দিয়েছেন সকলেই। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে, তাদের কর্তব্য কী। তবে রাজ্যেরই স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের ধারণা, সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে যে-কড়া মনোভাব দেখাচ্ছে, তাতে চিঠিচাপাটি চালাচালি করেও নির্দেশের বিশেষ কোনও হেরফের হবে না।

পরীক্ষার্থীদের কী অবস্থা?

১ মে এআইপিএমটি পরীক্ষায় বসবেন, এমন এক পরীক্ষার্থী জানান, নাম-কা-ওয়াস্তে পিএমটি-তে বসার কথা ভেবেছিলেন তিনি। তাঁর মূল প্রস্তুতি ১৭ মে-র রাজ্যের মেডিক্যাল জয়েন্টের জন্যই। দু’টি পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর লেখার ধরন আলাদা। ‘‘এমন একটা সময়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এল যে, এখন আর রবিবারের পিএমটি-র জন্য ভাল করে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগই পাব না। সর্বোচ্চ আদালত যদি আমাদের ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষাতেও (এনইইটি) বসার অনুমতি দেয়, বেঁচে যাব। না-হলে সমস্যায় পড়তে হবে।’’

এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন?

রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড বা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে এর জবাব নেই। কর্তারা বলছেন, ‘‘আমাদের মেডিক্যাল জয়েন্ট এ বছর থেকেই যে বাতিল হয়ে যাবে, বুঝব কী করে?’’

আকস্মিক নির্দেশে অকূলপাথারে পড়া পরীক্ষার্থীদের অবস্থা তুলে ধরে শুক্রবার অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহাতগি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। তিনি এ দিন শীর্ষ আদালতে বলেন, ‘‘বিভিন্ন রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের পরীক্ষার নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিও প্রায় সারা। এত কম সময়ের মধ্যে নতুন একটা পরীক্ষা ব্যবস্থায় সড়গড় হতে গিয়ে পরীক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়বেন। তাঁদের কথা ভেবেই আদালত নিজেদের সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখুক।’’

কেন্দ্রের তরফে ১ মে এবং ২৪ জুলাইয়ের দু’টি পরীক্ষাই একসঙ্গে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, সব পক্ষ নিজেদের বক্তব্য লিখিত ভাবে আদালতে জানাক। পরে আদালত তা খতিয়ে দেখবে।

আরও একটি সমস্যা হল, প্রতিটি রাজ্যে আঞ্চলিক বিষয়ে পরীক্ষা হয়। কিন্তু সর্বভারতীয় পরীক্ষায় তা হয় না। সেই জন্যও পরীক্ষার্থীদের অসুবিধা হতে পারে বলে কেন্দ্রের তরফে আদালতকে জানানো হয়। শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, এ বিষয়ে ৩ মে পরবর্তী শুনানি হবে।

অর্থাৎ সঙ্কট এখনই কাটছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Uniform entrance examination JEE
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE