Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মুখোশের আড়ালে কে, ধরাই দায়

কাঁপুনি ধরাচ্ছে ধোঁকা দেওয়া জ্বর

মামুলি সর্দি-কাশি। সঙ্গে জ্বর। ভাইরালের মতো। থার্মোমিটারের রিডিং থেকে থেকে চড়ছে, নামছে। দেখে-শুনে ডাক্তারবাবু প্যারাসিটামল খেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু চার দিনের মাথায় ফের বিপত্তি। দেখা গেল, ছেলের হাত-পা ঠান্ডা, কথা বেরোচ্ছে না।

ন’বছরের ছেলে দেবজিতের মাকে কেড়ে নিল ডেঙ্গি।  সোমবারই মৃত্যু হয় দমদমের বাসিন্দা পম্পা ভট্টাচার্যের। এ দিন দুপুরে পম্পার দেহ বাড়িতে আনা হয়। ছবি: সৌভিক দে।

ন’বছরের ছেলে দেবজিতের মাকে কেড়ে নিল ডেঙ্গি। সোমবারই মৃত্যু হয় দমদমের বাসিন্দা পম্পা ভট্টাচার্যের। এ দিন দুপুরে পম্পার দেহ বাড়িতে আনা হয়। ছবি: সৌভিক দে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৮
Share: Save:

মামুলি সর্দি-কাশি। সঙ্গে জ্বর। ভাইরালের মতো। থার্মোমিটারের রিডিং থেকে থেকে চড়ছে, নামছে।

দেখে-শুনে ডাক্তারবাবু প্যারাসিটামল খেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু চার দিনের মাথায় ফের বিপত্তি। দেখা গেল, ছেলের হাত-পা ঠান্ডা, কথা বেরোচ্ছে না। জিভ ঢুকে যাচ্ছে মুখের ভিতরে!

শেষমেশ হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। স্যালাইন চালাতে হল। কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচল দক্ষিণ কলকাতার ওই কিশোর।

উত্তর শহরতলির তরুণটির আবার প্যারাসিটামলে জ্বর পালিয়েছিল তড়িঘড়ি। দিব্যি চাঙ্গা। ঘুরেও বেড়াচ্ছিলেন এ দিক-সে দিক। তিন দিন বাদে শুরু হল হাত-পায়ের পেশিতে যন্ত্রণা। গায়ে লাল চাকা চাকা দাগও বেরোল। রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তারবাবু অবাক! এ যে ডেঙ্গি!

ঠিক উল্টো ভাবেও ধোঁকা খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। মধ্য কলকাতার সেই প্রৌঢ়ের কথা ধরা যাক। জ্বরের সঙ্গে মাস্‌ল পেন। একেবারে চেনা উপসর্গ। ডাক্তারবাবু নিশ্চিত ছিলেন, ডেঙ্গি। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ডেঙ্গি ভাইরাস পাওয়া গেল না। জ্বরও কমল না। ফের ব্লাড টেস্ট। এ বারেও রক্তে ডেঙ্গি-জীবাণুর হদিস নেই! অথচ প্লেটলেট নামছে হুড়মুড়িয়ে। হাসপাতালে নিতে নিতে প্লেটলেট কাউন্ট গিয়ে ঠেকল আট হাজারে! রক্ত দিতে হল। রোগী বাঁচলেন বটে, কিন্তু জানাই গেল না, রোগটা তাঁর কী হয়েছিল!

ডেঙ্গি তো আছেই। তার সঙ্গে কলকাতা ও আশপাশে ছড়িয়ে পড়া এই ‘অচেনা’ জ্বরের দাপাদাপিতে স্বাস্থ্য দফতরের ঘুম ছুটেছে। চিকিৎসকেরাও কোনও দিশা পাচ্ছেন না। উপসর্গ দেখে দেখে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করাচ্ছেন। কিন্তু পরীক্ষায় কিচ্ছুটি ধরা পড়ছে না!

ডেঙ্গির উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীই অবশ্য বেশি। তাই ডাক্তারেরা কেউ একে বলছেন ছদ্মবেশী জ্বর, কেউ বলছেন ডেঙ্গির মতো জ্বর। বেশির ভাগই প্যারাসিটামলের উপরে ভরসা রাখছেন। তবে বাড়াবাড়ি হলে হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া উপায় থাকছে না।

ডেঙ্গির প্রথাগত চিকিৎসায় অধিকাংশই সেরে উঠছেন। যদিও চিকিৎসায় দেরি হলে অনেক ক্ষেত্রে ‘কেস’ চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে। ‘ছদ্মবেশী’ জ্বরে সল্টলেক ও দমদমে গত দু’দিনে দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গির মতো তাদের দেহের ভিতরে রক্তক্ষরণ হলেও ডেঙ্গি ধরা পড়েনি। ডেথ সার্টিফিকেটে শুধু লেখা হয়েছে ‘হেমারেজিক ফিভার।’

দু’বছর আগে উত্তরবঙ্গে ‘এনসেফ্যালাইটিস সদৃশ’ জ্বরের বাড়াবাড়ি দেখা দিয়েছিল। এমতাবস্থায় সেই স্মৃতি হাতড়ে বার করে আনছেন স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ। ‘‘সে বার যারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, এনসেফ্যালাইটিসের চিকিৎসা করে আমরা তাঁদের সারিয়ে তুলেছিলাম। কিন্তু রক্ত পরীক্ষায় এনসেফ্যালাইটিস মেলেনি, এই যুক্তিতে যাঁরা হাসপাতালে যাননি, তাদের অনেকে মারা গিয়েছেন।’’— বলছেন এক স্বাস্থ্যকর্তা। ওঁদের দাবি, দক্ষিণবঙ্গেও এ বার সঙ্কটের একমাত্র দাওয়াই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা। বিশেষজ্ঞদের কী অভিমত?

বস্তুত গত চার দশকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘জীবাণুরা আমাদের হারিয়ে দিচ্ছে। আমরা এক-একটা টিকা বানাচ্ছি, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি বার করছি। কিন্তু জীবাণুরা জিনের চরিত্র পাল্টে পাল্টে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। বিভ্রান্ত করছে।’’

যেমন, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, জ্বর। অথচ চিকুনগুনিয়া নয়! গায়ে লাল লাল দাগ, পেশিতে যন্ত্রণা, চোখ ঘোরাতে গেলে ব্যথা। মানে, ডেঙ্গির আদর্শ উপসর্গ। এ দিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও রক্তে ডেঙ্গি-ভাইরাসের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

আবার পেশিতে ব্যথা নেই, লাল লাল দাগও নেই, তবু ডেঙ্গি ধরা পড়ছে! ‘‘এত দিন এ সব রোগ নিয়ে কাজ করেও মাঝে-মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলছি।’’— আক্ষেপ অমিতাভবাবুর। চিকিৎসক প্রবীর বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা— ‘‘কখনও গোড়ায় ঘাবড়ে গেলেও হাসপাতালে স্যালাইন বা রক্ত দিয়ে রোগীদের সুস্থ করতে পারছি। কিন্তু ঠিক কীসের জন্য ভর্তি হতে হল, রোগী জানতে পারছেন না। প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকছে, ভাইরাল ফিভার।’’

শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘এখন বহু বাচ্চার ভাইরাল ফিভার হচ্ছে। প্রথমে টেম্পারেচার খুব বেড়ে যাচ্ছে। কাশি হচ্ছে। সুস্থ হতে হতে পাঁচ-সাত দিন।’’ অপূর্ববাবুরও অভিজ্ঞতা, ‘‘অনেকের উপসর্গ দেখে ডেঙ্গি মনে হলেও পরীক্ষায় জীবাণু মিলছে না।’’ তাঁর পরামর্শ, ‘‘বেশি বেশি জল খান। যে কোনও জ্বরে বেশি জল খেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা।’’ প্যারাসিটামলও খেতে বলছেন। জানাচ্ছেন, জ্বর কমলেও অন্তত বাহাত্তর ঘণ্টা সাবধানে থাকা জরুরি। কারণ, অনেকের পায়ের পেশিতে যন্ত্রণা থাকছে। ফলে হাঁটা-চলায় অসুবিধে। গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কেন?

অমিতাভবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘প্যারাসিটামলে জ্বর কমতে সময় লাগছে। জ্বর ছাড়লে প্রবল ঘামের সঙ্গে অতিরিক্ত জল ও নুন বেরিয়ে শরীর ঠান্ডা করে দিচ্ছে। ডাক্তারি পরিভাষায়, পেরিফেরাল সার্কুলেশন ফেলিওর।’’

এ হেন রোগ-দুর্ভোগের পিছনে আবহাওয়ারও বড় ভূমিকা দেখছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য: এ বার শীতকালে তেমন শীত পড়েনি। বর্ষায় স্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে না। এমন পরিবেশে জীবাণুরা বেশি রকম সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি যত প্রতিকূল, জীবাণুরা ততই জিনের চরিত্র বদলে নিজেদের জাহির করছে। ‘তাই বিভ্রান্তি ক্রমশ বাড়বে।’’— পূর্বাভাস এক বিশেষজ্ঞের।

জ্বরের মুখোশের আড়ালে আসল রোগটা ধরা না পর্যন্ত বিভ্রান্তির পালা চলবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fever spreading
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE