Advertisement
E-Paper

ধান কাটা বন্ধ ঊর্মিলাদের

সংঘর্ষের তিন ঘণ্টা পেরিয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ খুস্তিগুড়ি, পলাশি হয়ে সিরশিট্টার ডোমপাড়ায় ঢোকার মুখেই একটি খামারবাড়িতে কয়েক জনের দেখা মিলল। সেখানে সবাই মহিলা আর কয়েকটি শিশু। সবার চোখেমুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ। সঙ্গে কেবল এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। সামনে একটি সাইকেল। সাইকেলে কোদাল ঝোলানো। গ্রামে এখন ঢোকা যাবে? চাপা স্বরে মোহন পাল নামে ওই গ্রামবাসী বলে উঠলেন, “যেতে পারেন। কিন্তু সাবধানে যান।” তিনি জানান, সকালে ক্যানালের কাছে নিজের খেতজমিতে কাজ করছিলেন।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৪
উঠোনে বোমার দাগ। সিরশিট্টা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

উঠোনে বোমার দাগ। সিরশিট্টা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

সংঘর্ষের তিন ঘণ্টা পেরিয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ খুস্তিগুড়ি, পলাশি হয়ে সিরশিট্টার ডোমপাড়ায় ঢোকার মুখেই একটি খামারবাড়িতে কয়েক জনের দেখা মিলল। সেখানে সবাই মহিলা আর কয়েকটি শিশু। সবার চোখেমুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ। সঙ্গে কেবল এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। সামনে একটি সাইকেল। সাইকেলে কোদাল ঝোলানো। গ্রামে এখন ঢোকা যাবে? চাপা স্বরে মোহন পাল নামে ওই গ্রামবাসী বলে উঠলেন, “যেতে পারেন। কিন্তু সাবধানে যান।” তিনি জানান, সকালে ক্যানালের কাছে নিজের খেতজমিতে কাজ করছিলেন। হঠাত্‌-ই দু’পক্ষের সংঘর্ষ শুরুর খবর পেয়ে গ্রামের দিকে ছুট লাগান। তাঁর কথায়, “আজ আর জমিতে কাজ করতে পারিনি। কাল থেকেই ঝামেলা চলছে। পুলিশ আসার পরেও সেটা যে এ দিনও গড়াবে তা বুঝতে পারিনি।” আপাতত অশান্তি থাকলেও কখন কী হয়, তার আতঙ্ক কাটছে না মোহনবাবুদের।

কাছেই পুকুরে স্নান করতে আসছিলেন প্রৌঢ়া ঊর্মিলা ডোম। তিনি জানান, শনিবারও তালিপুর মাঠে ধান কাটতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাইরে অন্য গ্রামে ধান কাটতে গেলে দশ টাকা মজুরি বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু অশান্তির জেরে ধান কাটা সব বন্ধ। ঊর্মিলাদেবী বলেন, “আজ সকালে কাজে যাইনি। কখন কী হয়। পরিবারের সঙ্গেই থাকতে চাই।” পাশ থেকে পূর্ণিমা ডোম নামে এক মহিলা জানালেন, সকাল থেকে এক কাপ চা অবধি খাওয়া হয়নি। গরু-বাছরও বাইরে বের করা যায়নি। একটা দোকানও খোলা নেই। তাঁর দাবি, “ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। বাড়িতে কোনও পুরুষ নেই। কী করে কী হবে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!”

এমনিতে সিরশিট্টা গ্রামের পশ্চিমপাড়া, খাদিমপাড়া, নামো, উত্তরপাড়া, দাইপাড়া, পালপাড়া তৃণমূল প্রভাবিত। অন্য দিকে, বিজেপি প্রভাবিত গ্রামের খাসপাড়া, মালিপাড়া, ডোমপাড়া, চাষাপাড়া। বাগদিপাড়ার বাসন্তী বাগদির সদ্যোজাত পুত্রসন্তানের আঁতুরঘরের পাশেই বোমা পড়ে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তৃণমূলের গুন্ডারা সেখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে। প্রতিবেশী নাসিরা বিবি, কাজলা বাগদিরা বলেন, “বোমার কান ফাটানো আওয়াজে বাচ্চাটা পুরো নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও মরেই গিয়েছে! কিছুক্ষণ পরে ও নড়ে ওঠায় সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলি।”

এ দিন পালপাড়া হয়ে পশ্চিমপাড়া যেতে গিয়ে চোখে পড়ল পড়ে থাকা গরুর গাড়ির উপরে কয়েক জন মাঝবয়সী লোক বসে আছেন। সকালের ঘটনা নিয়েই আলোচনা চলছিল। অপরিচিত মুখ দেখে সবাই চুপ করে গেলেন। গরুর গাড়ির সামনেই ডান দিকে একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে বাঁধা তৃণমূল ও বিজেপি-র পতাকা। অচেনা লোককে দেখেই ওঁরা পরিচয় জানতে চাইলেন। বলে উঠলেন, “আপনারা তো সবাই আসছেন। কিন্তু আসল ঘটনা দেখাবেন তো?” আসল ঘটনা? প্রশ্ন করতেই ক্ষোভের সুরে ওঁরা বললেন, “এই যে বিজেপি-র লোকেরা বোমা ফাটাতে ফাটাতে গ্রামে ঢুকল। কিন্তু টিভিতে উল্টো দেখাচ্ছে!” জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কি তৃণমূল করেন?” উত্তরে ‘হ্যা’ জানালেও কেউ-ই কিন্তু নিজেদের নাম জানাতে চাইলেন না। তবে, ঝামেলাটা কোথায় হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই জবাব এলো, “পশ্চিমপাড়া, খাদিমপাড়ার কাছে যান। সব উত্তর পেয়ে যাবেন।”


গ্রামে পতাকায় সহাবস্থায়।

পশ্চিমপাড়ায় পৌঁছে আরও কিছু তৃণমূল সমর্থকের দেখা মিলল। তাঁরা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বোমার চিহ্ন দেখালেন। যে কালভার্টের উপরে বিজেপি-র সমর্থকেরা মিছিল আটকেছিল বলে অভিযোগ, সেখানে এ দিনও হামলা চলেছে বলে দাবি করলেন। এমনকী, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বোমার চিহ্ন দেখালেন। সামনে মসজিদের দেওয়ালে গুলির চিহ্নও দেখালেন। তাঁরা জানালেন, এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। সঙ্গে মহিলারাও। সেখানেই উপস্থিত হাসমাতারা বিবি, হোসেনারা বিবিরা কোলে শিশু নিয়ে তৃণমূলের সুরে বিজেপি-র বিরুদ্ধে একই নালিশ জানালেন। সেখান থেকে বেরিয়ে পিচ রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়ল একাধিক বোমার চিহ্ন। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই বিজেপি-র লোকেরা কিংবা তাঁদের পরিবারগুলিই বা গেল কই? তৃণমূল সমর্থকদের কাছ থেকে কোনও উত্তর মিলল না।

গ্রামের ভেতরে তখন এক জনও পুলিশ ছিলেন না। ওই রাস্তা ধরে চৌমণ্ডলপুরের দিকে এগোতেই গ্রামের ডানদিকে পড়ে খাসপাড়া। দূরে তিনটে পুলিশের গাড়ি দেখা গেল। সিআই বোলপুর চন্দ্রশেখর দাসের নেতৃত্বে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স সেখানে ছিল। এগিয়ে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতেই খবর এলো, গ্রামে ফের হামলা হতে পারে। পুলিশ গ্রামে ঢুকল। তাঁদের পিছু নিয়ে আবার গ্রামে ঢুকতেই এক মহিলা পথ আটকালেন। “এই অশান্তিতে কীভাবে বাঁচবো বলতে পারেন? শান্তি কবে ফিরবে?” কাতর সুরে তিনি বলে উঠলে। হৃদরোগে আক্রান্ত ওই মহিলার এ দিনই বর্ধমানে চিকিত্‌সা করাতে যাওয়ার কথা ছিল। গ্রাম থেকে বেরতেই পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মহিলাই জানালেন, বাগদিপাড়া থেকে তৃণমূলের লোকেরা বিজেপি পরিবারগুলিকে তাড়িয়ে গ্রামের বাইরে বের করে দিয়েছে।

অবশ্য গ্রামের ভেতরে আরও দু’ ঘণ্টা থাকলেও কোনও অশান্তি নজরে পড়েনি। একসময় একটি ছোট দোকান খোলানো হল। অভুক্ত পুলিশকর্মীরা আর সাংবাদিক, সবাই সেখান থেকেই কিছু কিনে শেষমেশ নিজের নিজের পেট ভরালেন।

ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

parui when will peace return dayal sengupta sirshitta rice cut stopped urmila village bjp tmc clash state news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy