গোপী হালদার।
ঠিকানা ছিল না। তবু রাতের ঘুমটুকু ছিল। সেই ঘুমটাই চুরি গিয়েছে গোপী হালদারের।
বছর চল্লিশের গোপী বোবা। পেট চলে ভিক্ষে করে। রোজ দুপুর পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা বর্ধমান শহরের বীরহাটার বড়কালী মন্দির চত্বর। মন্দির থেকে কয়েক হাত দূরে তৃণমূলের জেলা পার্টি অফিসের সিঁড়িতেও মাঝেমধ্যে বসেন। দু’বেলা দু’মুঠো জুটেও যায় কোনও মতে। রাত কাটে কখনও স্টেশনে, কখনও বাসস্ট্যান্ড চত্বরে, আবার কোনও দিন বাঁকা নদীর ধারে। পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের পর আর পাঁচ জনের মতো রাত জেগে ভাবতে বসতে হয়নি গোপীকে। লাইন দিতে হয়নি ব্যাঙ্কে। সঞ্চয় থাকলে তবে তো ও সব ভাবনা!
দিনযাপনের চিন্তা ছিল। কিন্তু মনে ভয় ছিল না গোপীর। এখন ভয় করে। গুড়গুড় করে বুকের ভেতরটা। পুলিশ দেখলে কেঁপে কেঁপে ওঠেন। চারপাশে তাঁকে নিয়ে ফিসফাস। বুঝতে সবই পারেন। মুখের সঙ্গে মনটাও তখন কেমন বোবা হয়ে যায়। খবর ছড়িয়েছে। যত নষ্টের গোড়া, এক বান্ডিল ‘বাতিল’ নোট!
শনিবার মন্দিরের সামনেই পাওয়া গেল গোপীকে। গত শুক্কুরবারের ঘটনাটা জিগ্যেস করতে প্রথমে একটু থতমত খেলেন। তার পর অবশ্য একটু একটু করে খুলে বললেন সব। খানিক ইশারায়, খানিক কাগজে-কলমে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে দিব্যি লিখলেনও।
শুক্রবার দুপুরের পর মন্দির তখন প্রায় ফাঁকা। হঠাৎ কোথা থেকে এসে থেমেছিল একটা মোটরবাইক। বাইক থেকে নেমে কালো হেলমেট পরা বেশ ভাল চেহারার একটা লোক উঠে গিয়েছিল মন্দিরে। প্রণাম করে সে নামার সময়ে অভ্যেসবশেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন গোপী।
মুহূর্তে পকেট থেকে এক গোছা টাকা বের করেছিল কালো হেলমেট। গোপীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় বলেছিল লুকিয়ে ফেলতে। ঘাবড়ে গিয়ে জামার তলায় টাকাগুলো ঢুকিয়েও ফেলেন গোপী। হেলমেট তখন মোটরবাইকে উঠে সাঁ করে বেরিয়ে গিয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দিকে।
খানিক পরে আড়ালে গিয়ে নোটগুলো বের করেছিলেন গোপী। সব পাঁচশো আর হাজারের নোট। গুনে দেখেছিলেন, প্রায় দশ হাজার। অনেকক্ষণ ভেবেছিলেন। তার পর চুপিচুপি বাঁকা নদীর ধারে একটা পাঁচিলের ইটের ফাঁকে টাকাগুলো গুঁজে রেখে এসেছিলেন গোপী। কিন্তু সে রাতে আর ঘুম আসেনি চোখে।
অসহ্য রাতটা কাটতেই পাশে বসা অন্য ভিখারিদের কয়েক জনকে ঘটনাটা বুঝিয়ে বলেছিলেন গোপী। সেই পারুল খাঁড়ো, দশরথ কারাট, আন্না রাজবংশীরা আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘আমরা সবাই ওখানেই বসে থাকি। তবে গোপীর কপালটা ভাল।’’
সত্যিই কপাল ‘ভাল’? নোট না বদলালে ও টাকা তো কাজেই লাগবে না। মন্দির চত্বরের অন্য ভিক্ষুকরাই জানালেন, গোপীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। এত টাকা পেয়ে বড় আতান্তরে পড়েছেন। ঘটনাটা বেশি কাউকে জানাতে পারছেন না। আবার কাউকে ভরসা করে টাকাটা দিতেও পারছেন না। পুলিশের ভয় তো রয়েইছে। তার ওপর পাশে বসে ভিক্ষে করা অনেকেই এখন ওই টাকার ভাগ চাইছেন।
গোপীর অবস্থা এখন অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘টাকার আপদ’ গল্পের সেই বুড়ো মুচির মতো। যে রাতদিন কাজ করত আর গান গাইত গুনগুন করে। তার বাড়ির পাশেই থাকা ধনী বেনের মনে সুখ নেই, স্বাস্থ্যও নেই। বেনে এক দিন একশোটা টাকা ভর্তি একটা থলে দিয়ে আসে মুচিকে। সেই থলে মাটিতে পুঁতে রাখে মুচি। কিন্তু রাত হতেই তার মনে হয়, ‘ওই বুঝি চোর আসছে।’ এমনকী বেড়ালে ম্যাও করলেও সে চমকে ওঠে। পরের দিন সকাল হতেই বেনের কাছে গিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে মুচি বলে, ‘‘এই রইল তোমার টাকা। এর চেয়ে আমার গান আর ঘুম ঢের ভাল!’’ মুচির মতো ফুরফুরে জীবন হয়তো ছিল না গোপীর। কিন্তু দশ রকম আতঙ্কের সঙ্গে ঘর করতেও তো হতো না তাঁকে!
স্থানীয় বাসিন্দা হেমন্ত দাম, গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়েরা বলছিলেন, ‘‘একটা মোটরবাইকে এক জন এসে সে দিন ওই ভিখারির সামনে দাঁড়িয়েছিল বটে। কিন্তু কত জনই তো ওখানে দান করেন। তাই আর নজর করিনি।’’ আবার শোনা যাচ্ছে, ওই দিন সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সামনেও দু’জন ভিখারিকে কে যেন একই ভাবে টাকা দিয়ে গিয়েছে। ঘটনা কানে গিয়েছে পুলিশেরও। কে সেই ‘দাতা-কর্ণ’, খোঁজ নিচ্ছে বর্ধমান থানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy