এক ধাপ এগিয়ে গ্রামবাসীদের একাংশ দাবি করেছেন, এ দিন গ্রামে তৃণমূলের লোকেদের হামলা চালানোয় সুবিধা করে দিতেই এসেছিল পুলিশ। তাঁদের যুক্তি, মাখড়া যে পঞ্চায়েত এলাকায় পড়ে, সেই মঙ্গলডিহিতে রবিবার রাত থেকেই ১৪৪ ধারা জারি করেছিল প্রশাসন। পাড়ুই থানার ওসি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশ এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ মাখড়া গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালায়। তখনই গ্রামের পুরুষদের একটা বড় অংশ গ্রাম থেকে পালায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তল্লাশির পরে মাখড়ার দক্ষিণপাড়ার ক্যানালের পাড়ে চলে যায় পুলিশ। সেই সময় অন্তত শ’দেড়েক সশস্ত্র লোক গ্রামে ঢুকলেও পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই তাই বলছেন, “ঘটনাক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পুলিশ কেন আমাদের গ্রামে এসেছিল।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেপি সমর্থক পরিবারের একাধিক মহিলা ও তরুণীর অভিযোগ, “তৃণমূলের লোকেরা আমাদের কাউকে ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছে। কারও বাড়িতে ঢুকে শ্লীলতাহানি করেছে। মুড়িমুড়কির মতো বোমা মেরেছে। পুলিশ সব দেখেও ঠেকাল না কেন?”
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিজেপি-র তরফে পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হতেই বোমাবাজির তীব্রতা বাড়ে। পুলিশের গাড়ির কাছেই একটি বোমা ফাটে। তখনই পুলিশবাহিনী মাখড়া থেকে পিছু হটে মদনডাঙা-মাঝিপাড়া মোড়ে দাঁড়ায়। সেখানে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স এবং রাজ্য পুলিশের মিলিত বাহিনী প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়েই ছিল। কারণ জানতে চাওয়া হলে বীরভূমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় বলেন, “এ নিয়ে মন্তব্য করব না।” ঘণ্টা তিনেক পরে বোমাবাজি থামতে পুলিশবাহিনী গ্রামে ঢুকে তিন তৃণমূল কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।
এই পরিস্থিতি হলো কেন? ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) ত্রিপুরারি বলেন, “যা বলার, জেলার পুলিশ সুপার বলবেন।” পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া ফোন ধরেননি। তবে পুলিশের নিচুতলার আধিকারিকদের একাংশ ‘নিষ্ক্রিয়তা’র অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেননি। তাঁদের বক্তব্য, বোমা-গুলি-পাথর-ইটের মুখে পড়তে হয় নিচুতলার কর্মীদেরই। অথচ, তাঁদের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত সাহায্যও দেওয়া হয় না, জোগানো হয় না বাড়তি সাহস বা মনোবলও। আবার উঁচুতলার অফিসারদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতাদের (বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের) তুষ্ট করতে ব্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই ইচ্ছে থাকলেও নিচুতলার কর্মীদের কাজ করতে পারেন না। তাঁদের বক্তব্য, “এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের সংঘর্ষ ঠেকাতে গেলে দেখবেন আমাদের লাশ পড়বে।”
পুলিশকর্মীদের একটা অংশ আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শাসক দলের বিরুদ্ধে একাধিক বার পুলিশের উপরেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। পাড়ুই থানার ওসি অবশ্য সম্প্রতি বিরোধী বিজেপির হাতেই আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু তার আগে চলতি বছর জুলাইয়ে খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়িতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান বলে অভিযোগ। তার আগের মাসেই দুবরাজপুরে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারাত্মক জখম হন দুবরাজপুর থানার তরুণ এসআই অমিত চক্রবর্তী। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। ওই ঘটনাতেও অভিযোগের তির ছিল শাসক দলের নেতা-কর্মীদের দিকেই। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে মদ্যপ অবস্থায় দলবল নিয়ে বোলপুর থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে বীরভূম জেলা যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষের বিরুদ্ধে। তিনি এখনও অধরা। এই সূত্র ধরেই থানা স্তরের একাধিক অফিসারের স্বীকারোক্তি, শাসক দলের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা আছে মনে করেও নিষ্ক্রিয় হয়ে যান অনেক পুলিশকর্মী।